লবণের পুতুল সাগরে ঢুকলো... আলাদা কিছু রইলো না - সদগুরু
- Sadhguru
- 8 hours ago
- 3 min read
সদগুরু বলেন লবণের পুতুলের যাত্রা এক অভ্যন্তরীণ পথ—অন্বেষণ, প্রশ্ন করা, এবং শেষ পর্যন্ত অস্তিত্বের অসীমতায় বিলীন হওয়া। যতটুকু হারানোর মধ্যে, ততটুকু একতায় খোঁজ পাওয়া যায়। লবণের পুতুল সমুদ্রকে ভয় পায়নি, কারণ তার পরিণতি ছিল একাত্ম হওয়া, আলাদা না থাকা।

Story | Goa | April 15, 1980

সদগুরু : পুতুলের প্রশ্ন: দূর, বহু দূরে—বালির মতো ধূসর এক প্রান্তর। সেখানে ছিল একটি পুতুল, লবণ দিয়ে গড়া। তার চোখ ছিল বিস্ময়ভরা, হৃদয় ছিল সন্ধানী। সে ছিল অনন্ত পথিক, যার জন্ম হয়েছিল গভীর তৃষ্ণা নিয়ে—“আমি কে?”
তার শরীর লবণের, প্রতিটি দানায় ছিল অনুভবের ইতিহাস, কোনো এক বিস্মৃত নগরের প্রাচীন নিঃশ্বাস। পুতুলটির জন্ম হয়েছিল এক পাহাড়ি অঞ্চলে, যেখানে কেউ সমুদ্র দেখে না—শুধু শোনে। বাতাসে শোনা যেত এক সুর—জলের ডাক। আর সেই ডাকেই একদিন, সে রওনা দিল।
প্রশ্ন যত গভীর, উত্তরও তত কাছে আসে, শূন্যতার গভীরে।
“সমুদ্র কেমন?” – জিজ্ঞেস করত সে পথের পাখিদের, গাছদের, ঝর্ণার শব্দকে। কেউ বলত, “নির্বাক,” কেউ বলত “ভয়ংকর গভীর,” কেউ বলত, “তুমি একবার ঢুকলে ফিরে আসতে পারবে না।”
কিন্তু লবণের পুতুল তখনো বুঝতে পারেনি—‘ফিরে না আসা’ মানে কী।
লবণের পুতুলের হৃদয়ে বিস্ময় ছিল তার পথের সঙ্গী, কারণ বিস্ময়ই সমস্ত অনুসন্ধানের মূল।
পথে পথে অন্বেষণ: পাহাড় পেরিয়ে, মরুভূমি পেরিয়ে, সবুজ বনভূমি, নদী, এবং অবশেষে—সমুদ্রের গন্ধ পেল লবণের পুতুল। হাওয়ায় নোনা একটা ছোঁয়া। দিগন্তের দিকে তাকিয়ে সে দেখল, একটা নীল অসীমতা জেগে আছে, শব্দ করছে ঢেউয়ের ভাষায়।
বিলীন হওয়া কি? নিজেকে আলাদা না ভেবে, অসীমে মিলিয়ে যাওয়া।
তখন তার মনে প্রশ্ন জাগল—“আমি কী প্রস্তুত? আমার তো শরীর লবণের। এই জলে আমি গলে যাব না তো?”
হাওয়া ফিসফিস করে বলল, “হয়তো তুই হারিয়ে যাবি, কিন্তু সেই হারানোর মাঝেই তো আছে প্রকৃত খোঁজ।”
লবণের পুতুলের পথই প্রতিটি অনুসন্ধানকারী প্রাণীর পথ—একটি অবিরাম যাত্রা সত্যের দিকে।
পুতুল থমকে গেল। তারপর ধীরে ধীরে পা ফেলল জলের কিনারায়।
প্রথম ঢেউটা ছুঁয়ে গেল তার পায়ের আঙুল। সে কেঁপে উঠল। লবণ একটু গলল। কিন্তু তার মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তির ছায়া।
‘আমি কে?’ এই প্রশ্নেই আত্মার বিলীন হওয়ার চাবি hidden রয়েছে।
সমুদ্রের ভাষা: “কে তুমি?” সমুদ্র প্রশ্ন করল।
“আমি লবণের পুতুল,” সে বলল, “আমি জানতে চাই—তুমি কে?”
সমুদ্র হাসল। “তুই আমারই অংশ। তুই গলবি, হারাবি, তবু তুই আমাকে চিনবি। জানবি না বুদ্ধিতে—জানবি অস্তিত্বে।”
লবণের পুতুল সমুদ্রের অজানা জলকে ভয় পায়নি, কারণ সেই ভয়েই তার রূপান্তর ছিল।
“তাহলে আমি কি থাকবো না আর?”—পুতুলের কণ্ঠে ছিল আশঙ্কা।
“তুই থাকবে, কিন্তু নিজের নামে নয়। তুই থাকবি আমার ঢেউয়ে, আমার জলে, আমার গভীরতায়।”
পুতুল বুঝে উঠতে পারল না পুরোটা। তবু সে হাঁটতে লাগল, ঢেউয়ের মধ্যে, নিজেকে বিসর্জন দিতে।
গলনের আরাধনা: প্রতিটি ধাপে, তার শরীর থেকে কিছুটা করে লবণ গলে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই গলন তাকে কষ্ট দেয়নি। বরং সে যেন হালকা হয়ে যাচ্ছিল। বোঝা কমছিল। ভয়, ইচ্ছা, অহং—সব কিছু ছুটে যাচ্ছিল।
যতই সে গলতে থাকল, ততই অনুভব করল, “আমি আর আমি নেই—আমি জলের মতো।”
সমুদ্র কথা বলে না শব্দে, কিন্তু তার সঙ্গেই একটি আত্মার সুর মিশে থাকে।
তার ভিতরে কে যেন বলছে—“তুই এক, আমি এক। বিভাজন ছিলই না কখনও। শুধু খেয়াল ছিল না।”
তার স্মৃতি মুছে যাচ্ছিল। সে কীভাবে এল, কোথা থেকে এল—কিছু মনে পড়ছিল না। কিন্তু অদ্ভুতভাবে কিছু জানতেও ইচ্ছে করছিল না। কেননা সে জানত—এটাই যথেষ্ট, এটাই সত্য।
লবণের পুতুল প্রতিটি মানুষের প্রতিফলন, যে তার অস্তিত্বের প্রশ্ন করে।
অস্তিত্বহীনতার মধ্যেই অস্তিত্ব: শেষে, যখন লবণের শেষ কণা গলে গেল, তখন সমুদ্র নিঃশব্দে বলল—“এবার তুই আমি।”
আর কোনো প্রশ্ন ছিল না, আর কোনো খোঁজও না।
প্রতি পদক্ষেপে যে পৃথিবী সন্নিবিষ্ট, তা সমুদ্রেরই অংশ, এবং সে অংশের অন্তরীক্ষ থেকে জানতে হয়।
তখনো ঢেউ ছিল, শব্দ ছিল, সূর্য ছিল আকাশে, কিন্তু পুতুল ছিল না। তবু, কোথাও, এক অলৌকিক ভাষায়, এক অনুভবে, এক শান্তিতে—সে ছিল।

বোধিপুরুষের কাহিনী: হিমালয়ের এক গুহায়, এক সাধু ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছেন। তার শিষ্য জিজ্ঞাসা করল—“গুরুদেব, আত্মা কি সত্যি গলে যায়? মরে যায়? যদি এমন হয়, তবে আমি কে?”
গুরু চোখ খুললেন। তার চোখ ছিল অতল, সমুদ্রের মতো।
সমুদ্র লবণের পুতুলকে উত্তর দেয়নি শব্দে, সে দিয়েছে তার অস্তিত্বের গহনে।
তিনি বললেন—“একটা সময়, আমি ছিলাম এক লবণের পুতুল। জিজ্ঞাসা ছিল, পথ ছিল, যন্ত্রণা ছিল। তারপর আমি ঢুকলাম জলে… এবং গলে গেলাম। তারপর আমি কেবল আমি নই, আমি সবই। এখন আমি কে, তা বলার কিছু নেই। কারণ আমি আলাদা নই।” এটাই সেই আমাময় "The Amness."
শিষ্য স্তব্ধ। সে বুঝে উঠতে পারেনি সবটা, কিন্তু তার ভিতরে এক রকম জোয়ার উঠে গেল। যেন তার নিজের লবণ শরীর জল ছুঁয়ে কিছু হারিয়েছে, আর কিছু পেয়েছে।
সমুদ্রের গভীরে, লবণের পুতুল তার অস্তিত্বকে অনুভব করল, চিন্তা নয়, অনুভূতি থেকেই সত্য উদ্ভাসিত হয়।
নামহীন আত্মার আরাধনা: জীবনের প্রতিটি যাত্রাই, এক লবণের পুতুলের যাত্রা। প্রশ্ন আসে, দেহ গলে যায়, স্মৃতি মুছে যায়। তবু—একটা সত্য থেকে যায়, যেটা ভাষা নয়, বুদ্ধি নয়, অনুভব।
বিলীন হওয়া কোনও শেষ নয়, বরং শুরুতে ফিরে যাওয়া, যেখানে সবকিছু ছিল।
সেই অনুভবেই রয়েছে মুক্তি।
লবণের পুতুলের যাত্রা ছিল কোনও উত্তরের সন্ধান নয়, বরং সেই সত্যের মধ্যে আত্মসমর্পণ। খন তুমি নিজেকে সমুদ্রে বিলীন করো, তখন বুঝতে পারো—কোনও ‘আমি’ ছিলই না।
“লবণের পুতুল সাগরে ঢুকলো... আলাদা কিছু রইলো না।”
