Aবং হলো ১৯৮০ সাল থেকে তার সাধনার জীবনের নানা কাহিনীকে তুলে ধরা। পূর্ব জীবনকে জানার জন্য অবধূত নানা কাজের সূত্রেও সেই সব জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন সঙ্গে মিলিয়ে নিলেন নিজের জীবনের ছন্দকে। অবধূতের জীবনের নানা ঘটনাকে তুলে ধরা হবে এই Aবং বিভাগে। তাঁর শ্রীশৈলম ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এখানে দেওয়া হলো পর্বে পর্বে। আজকে অষ্টম পর্ব।
যাত্রা পথের বর্ণনা দিয়ে আর দীর্ঘায়িত করছি না। প্রায় ৫টা। পৌছালাম একটা জায়গায়। গলা শুকিয়ে কাঠ। একটা ঝোরা মতো আছে জল পড়ছে। সামনে। ডানদিকে একটা গুহা। অন্ধকার ঘুটঘুটে তার ভেতর। আকাশে এখনো আলো আছে। তাতে দেখা যাচ্ছে। এই জায়গাটাতে জঙ্গল বেশ কম। অনেকটা জায়গা বেশ পরিষ্কার। কয়েকটা গাছ দিয়ে একটা বাউন্ডারী করা আছে মনে হলো। সেই জায়গার বাইরে থেকে দেখতে লাগলাম। গুহাতে ঢোকার আগে।
মহারাজ ও পাশে দাঁড়িয়ে। বললেন এই আমার ডেরা। জাস্ট পা ফেলতে গেলাম মনে হলো কেউ ধাক্কা দিয়ে পিছনে ঠেলে দিলো। একটা অদৃশ্য কিছু ধাক্কা দিলো বুকে। পিছনে চলে গেলাম। মাঠে ফুটবল খেলায় যেমন একজন আর একজন কে দুহাতে বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় তেমন। প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম।
ঘটনায় কেমন যেন হতম্ভম্ব হয়ে গেলাম। দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে সোমসুন্দরজী হেসে উঠলেন। ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমিতো এখুনি পড়ে যাচ্ছিলাম। আপনি হাসছেন। কি আছে ওখানে পা ফেলতে এমন হলো কেন। প্রায় একনিঃস্বাসে বললাম কথা গুলো। বেশ খানিকক্ষণ হাসলেন উনি। থামছেন আবার হাসছেন।
না সেই হাসিতে ক্রূরতা নেই। এক শিশুর সারল্য। হাসির দমক থামলে বললেন আসলে আমি থাকবো না বলে একটু আলাদা করে বন্ধন দেওয়া আছে এই ডেরা। কিছু অন্য জীবকে পাহারায় বসানো আছে যাতে কেউ নষ্ট করতে না পারে।
মা-আ-আ-নে? ভু-উ-উ-উ-ত। বলছেন কি? এখানে ভূত পুষেছেন। আবার দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে হাসিতে মহারাজ। ভূত পুষেছি। আমার তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। সোমসুন্দরজী হেসেই চলেছেন। বললেন ভালো বলেছো। ভূত পোষা।
তা তোমার আর দোষ কি। তোমাদের ওখানে দেখ পিশাচ সিদ্ধ তিনমিনিটে বশীকরণ। সব ভূত পিশাচ পুষে রেখেছে।
শোনো এই জায়গা একটু উচ্চ স্তরের জীব দিয়েই সংরক্ষিত। যাদের তোমরা উপদেবতা বলে থাকো। যারা পাহারায় আছে তারা তো তোমায় চেনে না। কি উদ্দেশ্যে তুমি এসেছো। আমিও আগে থেকে জানাই নি।
কেমন যেন খটকা লাগলো। যে লোকটার সব কিছু schedule এ চলে সে জানালো না আমি আছি তার সঙ্গে। একেমন কথা। এমন মানুষ তো ইনি নন। তাহলে কি শুধু এই বিচিত্র অভিজ্ঞতা করাবার জন্য!
আমায় বললেন আমার হাত টা ধরে এস। ধরলাম ওনার হাত। সহজেই ঢুকে গেলাম। এগিয়ে চললাম গুহার দিকে। আমায় বললেন তোমার দেশলাইটা দিও। দিলাম। আগুন জ্বালিয়ে গুহার দিকে এগিয়ে গেলেন। আগের ঘটনার অভিঘাত কিনা জানি না। শুধু মনে হচ্ছে চারদিকে অশরীরীর উপস্থিতি। তারা যেন আমার সব কিছু মেপে নিচ্ছে। গুহার ভিতরে একটা হালকা আলো দেখলাম। প্রদীপ না মোমবাতি বুঝলাম না। আমায় ডাকলেন মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে এস। জিজ্ঞেস করলাম টর্চ আছে জ্বালাবো। বললেন হ্যাঁ জ্বালিয়ে নাও।
ব্যাগ থেকে টর্চ বার করে জ্বালালাম। গুহার দিকে ফেলতেই টর্চের আলোয় গুহার ভিতরটা খানিকটা দেখা গেল। ভিতরটা ঘন অন্ধকার। টর্চের বেশ জোরালো আলো যেন সেই নিকষ অন্ধকারকে দূর করতে পারছে না।
সামনে দেখলাম এক নেভা ধুনি। বাম দিকে কাঠের ব্যবস্থা। ডান দিকে একটা কম্বল পড়ে আছে। আমায় বললেন ধুনীর পাশ দিয়ে ভিতরে চলে আসো। বেশ সন্তর্পনে ভিতরে ঢুকলাম। মাথা সামলে। বেশ নিচু গুহা পথ।
ঢুকে দেখলাম আবার একটি গুহা। তাতে একটি প্রদীপ। চোখটা এতক্ষনে সয়ে গেছে অন্ধকার। একটা কম্বলের ওপর সোমসুন্দরজী বসে আছেন। বললেন ব্যাগ পাশে রেখে এবার বস।
বেশ খিদে খিদে পাচ্ছে। ব্যাগ রেখে বসলাম। বললাম এবার বলুন তো এই জায়গায় কি আপনি প্রেত সাধনা করেন। এতো বছর সাধনা করছেন কি সাধনা করছেন। কি দিয়ে এই জায়গা পাহারা দিচ্ছেন। আর উপদেবতা বললেন সেটাই বা কি?
প্রায় এক নিঃস্বাসে বলে যাওয়া কথা শুনলেন। বললেন বলবো বলবো। আগে তো একটু বস। বললাম বসেই তো আছি। দেখ জল আছে রাখা জল খাও। এতটা পথ হেটেছো। গুহার ভিতরে বেশ গরম। বাইরের মতো ঠান্ডা নেই। বেশ আরামপ্রদ। জল কোথায় বলতে দেখিয়ে দিলেন। একটা বড় কমণ্ডল। উঠে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম ভর্তি জল। বেশ ঠান্ডা। কেমন সন্দেহ হল। গুহার ভেতরে যা তাপমাত্রা তাতে এই জল এতো ঠান্ডা কি করে হয়। উনি তো নিয়ে আসেন নি। আমার সাথেই আছেন। বললাম এটা কদিনের জল। আজ তো আর আনেননি। অনেক পুরোনো জল। জল খাওয়া ঠিক হবে কি?
বললেন নানা একটু আগেই আনা। খুব ভালো জল। খেলেই বুঝবে। জিজ্ঞেস করলাম কে আনল? এখানে তো কেউ আছে বলে মনে হয়না। আপনি ছাড়া এইস্থানে গভীর জঙ্গলে আর কারো উপস্থিতি তো নেই। বললেন কেন, যে তোমায় ঢুকতে বাধা দিল? মানে সেই ভূত প্রেত আপনার জল এনে দেয়। হো হো করে হেসে উঠলেন। না না ভূত প্রেত হবে কেন। বললাম যে এক উপদেবতা আছেন পাহারায়। তুমি নিশ্চিন্তে আগে জল খাও।
কমণ্ডল তুলে গলায় জলটা ঢালতেই দেখলাম অপূর্ব স্বাদ। গঙ্গোত্রীতে একবার এমন জল খেয়েছিলাম। তেষ্টা ও ছিল অনেকটা জল খেয়েও ফেললাম। একটা প্রকান্ড ঢেকুর তুললাম। মনে হলো শরীর মন সব যেন জুড়িয়ে গেল।
যাকগে ভূতের জলই হোক এখন বাঁচি তো পরে দেখবো। আর সন্ন্যাসী তো আছেই। বললাম আপনি একটু জল খাবেন তো। বললেন হ্যাঁ দাও। কমণ্ডল টা এগিয়ে দিলাম ওনাকে। জল খেয়ে ফিরিয়ে দিলেন। রাখলাম কমণ্ডল আবার আগের জায়গায়।
খিদে টা এখন আর নেই। ভাবলাম একটা সিগারেট ধরাই। বার করলাম দুটো সিগারেট। সোমসুন্দর জী কে একটা দিয়ে নিজে একটা ধরাতে গেলাম দেখলাম দেশলাই নেই। মনে পড়লো মহারাজ তখন দেশলাই নিয়েছিলেন গুহায় ঢোকার আগে। বললাম আগুনটাতো আপনার কাছে, ও হ্যাঁ বলে আমার হাতে দেশলাই দিলেন। দুজনে ধরালাম।
একই জামা কাপড় গায়ে গত প্রায় দুদিন ধরে বেশ অস্বস্তি লাগছে। ভাবছি চেঞ্জ করে অন্য সেট টা পরবো। মহারাজ বলে উঠলেন সিগারেট খেয়ে আগে জামাকাপড় ছেড়ে ধুতিটা পরে নাও। ভালো লাগবে। বাইরে বেরোনোর আগে কম্বল টা গায়ে জড়িয়ে নিও। খুব ঠান্ডা এখানে। দরকারে শঙ্খিনী মুখে দিও। শুনলাম। উনি কম্বল ছেড়ে উঠে। ধুনীর দিকে গিয়ে ধুনিতে কাঠ দিলেন আর তারপর আবার একটু কি একটা তরল ঢাললেন। একটা গুঁড়ো মত ওপরে ছিটিয়ে দিলেন। আবছা আলোয় বোঝা গেলোনা কি কি দিলেন। দেশলাই মারতেই ধপ করে জ্বলে উঠলো। গন্ধে বুঝলাম ঘি আর কর্পূর।
বেশ আলো হল জায়গাটায়। ফিরে এলেন কম্বলে। এবার বুঝলাম ভিতরে বেশ ক'একটা কম্বল আছে। থালা ও বাটি আছে। বুঝলাম এখানে মাঝে মাঝে মানুষের আনাগোনাও আছে। না হলে এই সংসারের এতো সামগ্রী থাকতো না।
ফিরে এসে বললেন হ্যাঁ তোমার বোধ হয় খুব চা খেতে ইচ্ছা করছে। বন্ধু বান্ধব হলে একটু রামায়ন মহাভারত হয়ে যেত। কিন্তু যোগী মানুষ। ভন্ড নয়। ক্ষমতা অনেক। দেখিয়েছেন অনেক কিছু। জেনেছি ও প্রচুর। অনেক বিরক্তি চেপে বেশ সলজ্জ ভঙ্গিতে বললাম হলে তো মন্দ হতো না।
হাসতে শুরু করলেন। কি হলো হাসছেন কেন। খুব গাল দিচ্ছ তো? এখানে কে তোমায় চা খাওয়াবে ভাবছ? আরে তুমি আমার অতিথি। অতিথি নারায়ন। এত সংকোচের কিছু নেই। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এটা আমার ডেরা। এতদিনে তোমার তো এটুকু ভরসা হওয়া উচিত আমার ওপর। আমার কিছু বিভূতি তো তুমি দেখেছ।
বেশ খারাপ লাগলো। নিজেরই নিজের কাছে ছোট লাগল। ইনি তো আকাশগামিনী বিদ্যার অধিকারী। ফলে চাইলেই ঘুরে আস্তে পারেন কোথাও। ক্ষমা চাইলাম। বললাম না আসলে এই জঙ্গলে আপনি পাবেন কি ভাবে এসব। তাই আর কিছু বলিনি।
ভারতীয় যোগ বিজ্ঞান নিয়ে তোমার কোনো ধারণা নেই। গুরুর কাছ থেকে কিছু বিদ্যা পেয়েছো ঠিকই কিন্তু জীবন চলার বিদ্যা তো পাওনি। আর তিনি তোমায় সেসব এখনো দেননি কারণ তুমি সেই যোগ্যতা এখনও অর্জন করো নি। যোগ বিজ্ঞানের এই পথ যোগীকে স্বয়ং সম্পূর্ণ করে। আগামী দিনে তুমি বহু বিদ্যার কথা জানবে ও দেখবে। যা এতদিন রূপকথার মতো মনে হয়েছে। পড়ে বিশ্বাস করতে পারোনি। ভেবেছ গঞ্জিকার আশ্রয়ে এসব লেখা। আচ্ছা তুমি নর্মদা নিয়ে তো বই পড়েছ, সেখানে তো খাবার ব্যবস্থা হয়েছে দেখেছো কেমন মন্ত্র শক্তিতে। মনে আছে। বললাম সেতো অটোবায়োগ্রাফি অফ যোগীতেও পড়েছি। হ্যাঁ সেগুলো পড়েছো। কিন্তু তোমার conviction নেই। তাই believe করতে পারোনি। কিছুটা ভক্তি রসে ওসব জারিয়ে নিয়েছো। আর ভেবেছো আগে হতো। আরে সেগুলো তো আর ত্রেতা যুগে নয়। কলিকালেই। নয় ৫০-১০০বছর আগের কথা। বেশ কেটে কেটে কথা গুলো বললেন সোমসুন্দরজী। বুঝলাম একটু রাগ হয়েছে। বললাম হ্যাঁ মহারাজ পড়েছি। কিন্তু আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। তাকে প্রত্যক্ষ না করে believe হবে কি করে? তারপর সেটা রেপিটেটিভ না হলে কি করে বলি এটা বিজ্ঞান? তারপর তার কার্য্য কারণ ব্যাখ্যা চাই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন এই জন্য তোমাদের বাংলায় এবং পূর্ব ভারতে সঠিক যোগবিজ্ঞান গুলো সেভাবে বিকশিত হয়নি। যারা ছিলেন তারা সবাই কাশীধাম বা উত্তরে হিমালয়ে সরে গেছেন। আর কেউ কেউ নর্মদায়। চটজ্বলদি প্রয়োগ হয় তন্ত্র দ্বারা তাইই বেশি করে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনিই পূর্ব দিকে দেবীর প্রভাব বেশি থাকবে। ঠিক বুঝলাম না কি বলতে চাইলেন। চুপ করে শুনে নিলাম। বললেন তুমি যোগবিজ্ঞান কে সম্পূর্ণ না জেনে কিভাবে তুলনা করবে বর্তমান বিজ্ঞানের সাথে । যখন তুমি দুটো বিষয় কে সম্পূর্ণ জানবে তবেই তো দুটোর তুলনা করা যায়।
বললাম হ্যাঁ, সেটা ঠিক। এখন শোন। আমার মনে হলো কোথাও যেন একটা প্রচেষ্টা আমাকে convince করার। কিন্তু কেন? আমার এই গুহা ও সংলগ্ন এলাকা পাহারায় আছে এক যক্ষ। চোখ আমার কপালে ওঠার জোগাড়। বললেন এই যক্ষরা হল উপদেবতা। যক্ষ আর যক্ষিনী। বেশ ইন্টারেষ্টিং টপিক। ভারতের কত মন্দির গাত্রে তাদের কত বিচিত্র সব ছবি। পাথর কুঁদে। মহাভারতের যুধিষ্ঠিরকে যক্ষ এর কত প্রশ্ন?
মহাকবি কালিদাস তার মেঘদূতম এ লিখেছেন এই যক্ষকে নিয়ে। আমরা কিছু জীব বা being কে বলি উপদেবতা আর কিছু আছেন অপদেবতা। তোমরা যাকে ভূত প্রেত বলো তাদের আমরা অপদেবতা বলি।
যক্ষ যক্ষিনী, অপ্সরা বিদ্যাধর, কিন্নর কিন্নরী, গন্ধর্ব এসবই হলো উপদেবতা। এদের ক্ষমতা মানুষের চেয়ে বেশি অনেক। তবে এদের অনেকটাই মায়ার ক্ষমতা।
দেবতারা যেমন স্বাত্তিক কিন্তু এই উপদেবতারা হলেন রাজসিক।
বলুন না মহারাজ এদের সম্বন্ধে। কাশী ধামে তোমার এদের সাথে সাক্ষাৎ হবে। আপনি জানেন? হ্যাঁ। তাই বললাম। শুধু এটুকু জেনে রেখো ১৬ রকমের যক্ষ আর যক্ষিনী আছেন। এরা দেখতে খুব সুন্দর। এই বিদ্যা না জানলে এদের দ্বারা তোমার ভালো ও যেমন হতে পারে ক্ষতিও হতে পারে। তুমি ওকে চালনা না করতে পারলে ও তোমাকে চালনা করবে। অত্যন্ত বুদ্ধিমান এই যক্ষরা। যক্ষ কাউকে ধরলে আর ছাড়ে না। এরা দেখতে খুব সুন্দর। যক্ষিনীরা ও অসাধারণ রূপসী। সুন্দরী মেয়েদের এরা আশ্রয় করতে চেষ্টা করে।
না দেখলে কি করে বুঝব মহারাজ? উৎসাহে তখন ছটপট করছি। যদি দেখা যায়। আমার বিদ্যায় তাকে তোমায় দেখাতে পারলেও কিছু অসুবিধা আছে তোমার তাই বললাম তোমার সময় আসবে কাশী ধামে গিয়ে তাকে তুমি দেখবে। আর পূর্ণিমার আগে তাকে তোমায় দেখাতেও পারবো না। আজ শুক্লা দ্বাদশী। কাল একাদশী তে বাম মার্গ দেখিয়েছি। কাল শুক্লা ত্রয়োদশী। কাল আর পরশুর মধ্যে করতে হবে আমার কিছু কাজ। ত্রয়োদশীই আমার জন্য ভালো তাই চেষ্টা করবো কাল ই শেষ করতে।
কবে কাশীধামে গেলে হবে? কাশী ধাম তুমি অনেক বার যাবে, কিন্তু সঠিক মানুষ পেতে অনেক দেরি আছে। আবার যেন কেমন ঝিমিয়ে পড়লাম।
সোমসুন্দরজী উঠে ধুনি খোঁচাতে গেলেন। আগুন টা বেড়ে গেল। বললেন বস। আমি না আসা অবধি বাইরে যাবার চেষ্টা করো না। আমি এখুনি আসব।
বেরিয়ে গেলেন। সব জানেন। অথচ কেমন নিস্পৃহ। কি অদ্ভুত মানুষ। এমন মানুষ পেলে তো সবাই হামলে পড়ে, বলে দাও ঠাকুর আমার কি হবে, ভবিষ্যৎ কি হবে, চাকরি ব্যবসা কি হবে। যার যা চাহিদা। আমার কেন এসব জিজ্ঞাস্য নেই। না ভূত না ভবিষ্যৎ।
সোমসুন্দরজী ঢুকছেন হাতে একটা কিছু। ধুনীর কাছে আস্তে বুঝলাম একটা প্লেট। তাতে কিছু আছে। এগিয়ে এসে বসলেন আমার পাশে। খুব সুন্দর একটি প্লেট তাতে দুপাত্র চা। গরম একেবারে। ধোয়া টা সুন্দর উঠছে। আর কিঁছু বাদাম। বললেন খাও।
চায়ের গন্ধ মন তাজা করে দিল। না দুধ চা নয়। চুমুক দিয়ে বুঝলাম বেশ ভালো চা। এই গহীন জঙ্গলে এতো ভালো ব্যবস্থা। জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা আপনি কি এমন রোজ ই খান? হাসলেন, বললেন আমার এসব কিছুই লাগে না। তুমি এসেছো তাই। কোন প্রয়োজন ও হয় না।
চা খেয়ে একটু বিশ্রাম করে নাও। চাইলে ঘুমিয়ে নিতে ও পারো। বাদাম সহযোগে চা খেলাম। বললাম রাতে কি শঙ্খিনী খেয়ে শুয়ে পড়বো। বললেন না। রাতের খাবার আনব। এখন বিশ্রাম করে নাও।
কখন যে আধঘুমে চলে গেছি নিজেও বুঝিনি। হয়তো এতটা হাঁটার ক্লান্তি। তন্দ্রা ভাঙলো মহারাজের ডাকে উঠে পড়ো। খাবার এসে গেছে। একটি প্লেটে ই খাবার। বললাম আপনি খাবেন না? বললেন না। আমি দিনে একবার ই খাই। রাতে আর খাই না।
লুচি তরকারি আর একবাটি পায়েস। বেশ বিস্ময়ে বললাম এসব কথা থেকে মহারাজ আসছে। বললেন খাও এখন। সব জানবে সময় আসলে। এই বিদ্যা তুমি পরে শিখবে উত্তরকাশীতে। এক সন্ন্যাসী তোমায় শেখাবেন। এখন খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।
খিদেও পেয়েছিল। খেতে খেতে বললেন কাল জঙ্গলে যাবো একটু তোমায় নিয়ে। ভয় নেই তোমার। আর আজ রাতে আমি সাধনায় থাকব। যদি ঘুম ভেঙে কিছু দেখ তবে যেন ভয়ে চিৎকার করে উঠো না। কেন কি ঘটবে। এখানে কি বিভৎস্য কিছু হবে নাকি? যক্ষ আসবে? আরে না না। তোমার এমন সব অভিজ্ঞতা আগে তো হয়নি তাই ভয় ঘাবড়ে গিয়ে চিৎকার করে উঠো না।
বুঝলাম কিছু একটা ঘটবে। পায়েস টা সত্যি অপূর্ব। ভালো করে খেয়ে থালা বাইরে রাখতে যাবো আর হাত ও ধোবো ভেবে উঠলাম। মহারাজ গোটা গায়ে ভালো করে কম্বল জড়িয়ে দিলেন। ঘড়িতে দেখলাম রাত ৮টা।
বাইরে বেরোতেই কেমন যেন মনে হচ্ছে কেউ আমাকে দেখছে। প্রায় গায়ে গা ঘেঁষে হাটছে। থালা টা রাখলাম। চাঁদের আলোয় খুব সুন্দর লাগছে চারদিক। সামনে পূর্ণিমা আসছে। ঝোরার জলে আলো পড়ে মনে হচ্ছে ঠিকরাছে অনেক হিরে। একটু এগিয়ে হাত বাড়িয়ে হাতটা ধুলাম। বেশ ঠান্ডা জল। বাইরেও খুব ঠান্ডা। ভাবছিলাম কি জগৎ। কত কিছুই আমাদের জানা চেনার বাইরে। মহারাজ যেন পুত্র স্নেহে আমায় বসিয়ে খাওয়ালেন। আমি খেতেই ওনার কত তৃপ্তি।
ভেতরে এলাম। ভরা পেট তাই ভেতরের গরমে ঘুম আসতে সময় লাগলো না।
ঘুম ভাঙলো হটাৎ। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিক। প্রদীপটাও জ্বলছে না। আমার ঘড়ির আলো তেই দেখলাম রাত ২টো। ধুনীর দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। ধুনীর আলো তে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে একটা লোক কেমন উল্টো হয়ে ভাসছে। পাশে হাতড়িয়ে দেখলাম মহারাজ আছে কিনা। দেখলাম নেই। ধুনীর পাশের কম্বলেও কেউ নেই। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। কালকের ঘটনায়ও এতো ভয় পাইনি। নিজের হৃদপিণ্ডের শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছি।
দুহাতে চোখ কচলে নিলাম। যা দেখছি ঠিক তো। যেন চলচ্ছক্তি হীন আমি। দেখলাম মহারাজ। মায়ের গর্ভে শিশু যেমন করে ঘোরে, তেমনি ভাবে কুঁকড়ে থাকা মহারাজ। হেঁটমুন্ড উর্ধপদ। ধুনীর চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে। শান্ত হলাম ধীরে ধীরে। দেখার চেষ্টা করলাম কিছু কে অবলম্বন করে ঘুরছে কিনা। না। এই কি তবে লঘিমা? Anti-gravity? তবে কি ইনি লঘিমা সিদ্ধ। অষ্ট সিদ্ধিই যদি হয়ে থাকে তবে তো ব্রহ্ম জ্ঞানী। তাহলে বললেন কেন আত্মসাক্ষাৎকার হয়নি। মিথ্যা তো এমানুষ বলবেন না। নাকি এ কোনো বিশেষ তান্ত্রিক ক্রিয়া।
গোটা গুহা গমগম করে উঠলো শুরু হল ত্রিপুরা রহস্য পাঠ। কেঁপে উঠলাম আমি সেই মন্ত্রের অভিঘাতে। কে করছেন এতো রাত্রে এই অসাধারণ গলায়। তবে কি সোমসুন্দরজী? প্রতিটি উচ্চারণ শরীরের সমস্ত কোষ কে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। থাকতে পারলাম না। বসে গেলাম ধ্যান এ। এতো দ্রুত সাম্ভবী মুদ্রায় স্থির হলাম যা সহজে হয়না।
কখন সকাল হয়েছে জানি না। কি ঘটেছে তাও বলতে পারবো না। গুহায় কেউ নেই। ফাঁকা। গোটা শরীর যেন হালকা। ফুরফুরে। গুহাপথ দিয়ে আলোর রেখা। হাতের ঘড়ি তে দেখলাম ৬টা।
সিগারেট খুঁজে সবে ধরিয়েছি। সোমসুন্দরজী ঢুকলেন হাতের প্লেট এ দুপাত্র চা। কাল কি খুব ঘাবড়ে গেছিলে বলে হাসতে শুরু করলেন। বললাম ঘাবড়াবারই তো কথা। কখনো তো দেখিনি। আপনি কি করছিলেন। বললেন আগে তো চা খাও। তোমার ওই সিগারেট দাও একটি।
চা খেতে খেতে বললেন কাল আমার গুরুদেব এসেছিলেন। তিনিই মন্ত্র উচ্চারণ করছিলেন। ত্রিপুরা রহস্য। তাকে তো দেখলাম না। তিনি সূক্ষ্ম দেহে ছিলেন। তোমার দেখার ক্ষমতা নেই। আর মন্ত্র ও তুমি শোনো নি কানে। শুধু তোমার সমস্ত নাড়িতে তার নাদ অনুভব পাচ্ছিলে। আজ আমার কায়াকল্প আছে, তাই। ভোর ভোর চোখ কপালে। বলেন কি। তুমি কায়াকল্প জানো?
না জানি না সেভাবে। ওই ওপর ওপর। আপনি কি স্বকায়াকল্পে দেহ কে এখানেই স্থির করে দেবেন? বললেন না, তোমার অবধূত তোমায় স্বকায়াকল্পের মন্ত্র দিয়েছেন জানি। তবে আমি এখনো নিজেকে আমি সেই জায়গায় নিয়ে যেতে পারিনি আর এই দেহর আর ক্ষমতাও নেই শক্তি ধারণ করার, তাই পরকায়াকল্প।
ও। কেমন যেন ভিরমি খেয়ে যাবার জোগাড়। গুরু ভগবান কে অনেক কৃতজ্ঞতা জানালাম এমন দুর্লভ ঘটনা দেখার সৌভাগ্য করে দেবার জন্য। তাতে তো অন্য দেহ লাগবে? প্রশ্ন করেই কেমন বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠলো। তাহলে কি আমি? সন্দিগ্দ্ধ মন। পরক্ষনেই ভাবলাম সেতো মৃতদেহ লাগে। বললাম মহারাজ পরকায়াকল্প তে তো মৃতদেহ লাগবে। বললেন হ্যাঁ। কোথায় পাবেন এখানে?
বললেন চা শেষ করো। তারপর বেরবো। কোথায় বেরোবেন। কিভাবে পাবেন মৃতদেহ? কেমন হবে তা? হাসলেন। চা খাও। ওঠ। সব ব্যবস্থা আছে। চা খেয়ে উঠে পড়লাম। নিজের তৈরী হতে একটু সময় লাগলো। প্রায় ৭টা বাজে। এসব করতে করতে কখন যে ১ঘন্টা কেটে গেছে বুঝিনি।
আজ মহারাজ কে খুব উৎফুল্ল লাগছে। বেরোলাম দুজনে, বললেন মৃতদেহ দেখলে ঘেন্না বা ভয় পাবে না তো। বললাম না। তবে তেমন বিকৃত দেহ দেখলে কি হবে কি করে বলি? উৎসাহের চোটে ঘেন্না ভয় সব ছুটে গেছে। হাসতে লাগলেন। বেরিয়ে এলাম ওই যক্ষ ঘেরা জায়গা থেকে। সেই ফুট পাঁচেক চলাচলের পথ। তারপর আবার সেই রেখা। চললাম মৃতদেহর খোঁজে। ভাবতে শুরু করলাম মৃতদেহ পাবেন কি করে এই জঙ্গলে? এখানে তো কেউ আসে না।
বললেন ঘাবড়াচ্ছো কেন? এখন চল আমার সাথে। এতো কৌতূহল কি চাপা যায়? এতো ফুল ফান্ডা? নিজের কৌতূহল কে অন্য দিকে ঘোরাবার জন্যই জিজ্ঞেস করলাম মহারাজ একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? বললেন বলো। আচ্ছা একজন মানুষ একজন কে অত্যাচার করছে। নারী নির্যাতন হচ্ছে। শিশুদের কে নিয়ে অত্যাচার হয়। এগুলো তাহলে কি? ঈশ্বর কি পুতুল খেলে? মুখের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন রাস্তায়? আমিও হটাৎ গতি কমিয়ে থামতে গিয়ে প্রায় হোঁচট খেলাম।
বললেন যতদূর জানি তুমি কর্ম মান, কারণ তোমার গুরু তোমার প্রতিপ্রসব (Past Life Regression) সাধনা শেখাবার সময় তোমায় পূর্ব জীবনে নিয়ে গেছিলেন। কর্ম দেখেছো, প্রারব্ধ কি বুঝেছ। বললাম হ্যাঁ।
কিভাবে জন্মের পর জন্ম তোমায় উনি পিছনে নিয়ে গেছেন আর একেকটি ঘটনায় ক্ষমা প্রার্থনা করিয়েছেন তোমায় দিয়ে। তোমায় ক্ষমা করতে বাধ্য করিয়েছেন সেই সব মানুষ বা জীব জন্তুকে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছি। মুখ দিয়ে আর কথা সরছে না। ভাবছি আমার গুরু অবধূত কি ছলনা করে অন্য্ দেহ ধারণ করেছেন আমায় শিক্ষা দেবার জন্য। এতো পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা কিভাবে সম্ভব?
কি বল? হ্যাঁ মহারাজ। সম্বিৎ এলো। চলে গেছিলাম আমার প্রতিপ্রসব সাধনায়। হ্যাঁ। এই জগৎ ও কর্ম আর প্রতিহিংসা নিয়ে ব্যস্ত। আচ্ছা আজ তোমায় একটা সহজ ডেমোনেস্ট্রেশন দি। তুমি তো ডেমো দেখতে খুব ভালোবাস। বললাম হ্যাঁ। হাসতে হাসতে বললেন তোমার নিজের প্রতিপ্রসব হয়েছে। সব বুঝেও যদি একথা জিজ্ঞেস করো। চল আমার সাথে। যাত্রা পথেই জুটে যাবে কিছু না কিছু।
এগোতে লাগলাম। প্রায় মিনিট ১০ হাঁটা হলো। হটাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন। হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিলেন আমায়। আঙুলের ইশারায় শব্দ করতে বারণ করলেন। আবার ইশারা। আঙুলের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটু দূরে একটা জায়গা দেখাচ্ছেন। একটা বেজি আর একটা গোখরো। বেজি টা ছোট। গোখরো টা বেশ বড়। বেজি দুপায়ে ভর করে আক্রমণের জন্য তৈরী। গোখরো ও ফণা উঁচিয়ে।
একবার ওদের দেখছি আর একবার মহারাজ কে। ওনার দুচোখ ওপরে। বুঝলাম সাম্ভবী তে চলে গেছেন। কয়েক মিনিট। দুটো প্রাণী যেন স্থির হয়ে গেলো।
মহারাজ স্বাভাবিক হলেন। আমাকে বললেন জীবনের পর জীবন এরা এই করছে। একবার এ একে মারছে তো আর একবার ও একে। ও কেন মেরেছে? আমিও মারব। শুনলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। তাহলে কি আপনি এদের প্রতিপ্রসব করাবেন। সে ক্ষমতা কি আমার আছে। সে তোমার গুরু হলে করাতেন। হ্যাঁ একটা ব্যাঙ নিয়ে ঘটনা উনি বলেছিলেন। হ্যাঁ। আমি শুধু ওদের ভাষায় ওদের বোঝালাম। যাতে এই জীবন থেকে ওরা বেরোতে পারে। বুঝলে? একদম straight bat এ প্রশ্ন? একটু পরে ফেরার পথে বুঝবে। যদি বোঝে কেউ থাকবে না, আর যদি না বোঝে তো একটি মৃতদেহ এখানে থাকবে। এবার কি তোমার প্রশ্নের উত্তর পেলে। মানুষ ও এমনি। আর যত দিন যাচ্ছে তত তাদের এই ক্রোধের বহিঃ প্রকাশ বাড়ছে। কোনো কিছুই তারা ক্ষমা করতে পারছে না। একজনের ওপর ক্রোধ অন্যের ওপর দিয়েও চালাচ্ছে যখন তাকে সামনে পাচ্ছে না। গুরুর কাছে যাচ্ছে আধ্যাত্মিকতা শিখতে নয় শুধু জীবনের প্রয়োজন মেটাতে। গুরু কেন করে দিচ্ছে না।
গুরু কেন করে দেবে? তোমার কাজ তোমায় করতে হবে। গুরু শক্তি দেবেন। সেই শক্তি তে সাধনা করে করে নিজের প্রারব্ধ কে ক্ষয় করতে হবে। মনের শুদ্ধতা আনতে হবে তবেই উন্নতি হবে। জাগতিক উন্নতি তো এমনি আসবে যদি কারো আধ্যাত্মিক উন্নতি হয়। বললাম by product? বললেন কিছুটা। কিন্তু এটা তো জানো জাগতিক উন্নতি তো আপেক্ষিক। আর আধ্যাত্মিক উন্নতি তো আপেক্ষিক নয়। তুমি চাহিদা কমাতে পারলে না ধার করলে আবার রোজগার বাড়লো না তাই ধার মেটাতে পারছো না। miracle চাইছো যাতে তোমার ধার শোধ হয়। কেন প্রথমেই চাহিদা কমাতে পারছো না। কেন সবাই কে বোঝাতে পারছনা ওটা ছাড়াও চলতে পারে, হয়ত একটু বেশি পরিশ্রম করতে হবে। কোথাও যেন সর্বদা এক মিথ্যে অহমিকা। প্রতিযোগিতা, অথচ মুখে বলছো না আজকের যুগে এটা প্রয়োজন। প্রয়োজন কে সিদ্ধান্ত নিয়েছে? তোমার আসে পাশের সমাজ দ্বারা তুমি। তুমি নিজেকে চালনা করতে পারছো না। বহির্জগতের সমাজ তোমায় চালনা করছে। তুমি চালিত হচ্ছ। তোমার চালনা করার ক্ষমতা নেই কারণ তোমার সেই অন্তরের শক্তি নেই। আর নেই বলেই তোমার মধ্যে সেই নমনীয়তা বা flexibility তৈরী হয়নি। সেই শক্তি তৈরী করার জন্য যেটা প্রয়োজন সেটা না করে শুধু ভাবছ এ করে দেবে ও কেন করে দেবে না। বুঝলাম খুব ঝাড় দিচ্ছেন।
বললেন ওর তো এতো ক্ষমতা ও কেন তাহলে করে দিচ্ছে না। আগে নিজেকে নিজে চালনা করতে শেখ। তবে দেখবে বাকি সমাজ একদিন তোমার পিছনে যাচ্ছে। আর তা যদি না শেখ তবে দেখবে সমাজ তোমায় চালাচ্ছে। এই যেমন এখনই ভাবছো মহারাজ যদি এই পশু পাখি দের সাথে কথা বলার বিদ্যাটা দিতেন তাহলে ওদের সাথে কথা বলতাম।
এতক্ষন মাথা নিচু করে শুনছিলাম। জাস্ট একলাফে সোজা হয়ে বললাম হ্যাঁ মহারাজ যদি একটু দিতেন। শুনেছি মন্ত্রসিদ্ধি হলে যার হয়নি তাকে ও অনুভব করানো যায়। একটু খানির জন্য। বেশি না দু তিনটে কথা বলেই বন্ধ। যেন ছেলে পরীক্ষার আগে একটু টিভি দেখার পারমিশন চাইছে।
আমার অবস্থা দেখে হেসে ফেললেন। বললেন কুকুরের ল্যাজ কি আর সোজা হয় যতই ঘি দিয়ে মালিশ কর। এই জন্যই তো তোমায় দেয় নি এই বিদ্যা তোমার গুরু। না ওই একটু জাস্ট অভিজ্ঞতা করার জন্য। বললেন আমি এই ক্ষমতা পেলেও তা তোমাকে অনুভব করাবার যোগ্যতা অর্জন করিনি। আর তাছাড়া তোমার গুরু ও তোমায় এব্যাপারে উপযুক্ত মনে করেন নি।
বুঝলাম দিল্লি বহুদূর। আমায় বললেন ওরা এখন খানিক ক্ষণ এভাবে থাকবে। আমরা চলো। অনেক সময় গেল। এখনো অনেকটা পথ। এগোলাম। রাস্তা সেই রেখা। একটা ছোট্ট ঝোরা। সরু করে জল পড়ছে। টপকে গেলাম। এবার রাস্তাটা নামছে নিচের দিকে। একটু চওড়া হলো। ধীরে ধীরে প্রায় ফুট খানেক পাথুরে রাস্তা। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আদিবাসীরা কাঠ কেটে মাথায় করে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ আবার কাঠ কাটতে আসছে।
হটাৎ হাত টা ধরে হ্যাঁচকা টান। ডানদিকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন আমায়। এখানে বেশ জঙ্গল আবার। বাম দিকে জঙ্গল অনেক ফাঁকা ফাঁকা। গাছপালা সরিয়ে নিয়ে চললেন। তার শক্ত হাতে আমি ধরা।
বাবা কি ঘন জঙ্গল। লতা পাতায় হাত পা জড়িয়ে যাচ্ছে। আবার বাঁক নিলেন ডানদিকে। একটু উপরে। দাঁড়িয়ে গেলেন। আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম ওনার সাথে। সামনে দেখি একটি বছর ১২/১৩র ছেলে শুয়ে আছে। হাতে একটা হেঁসোর মতো ধরা। গায়ে উর্ধাঙ্গে কোনো পোশাক নেই। নিম্নাগ্নে একটা হাফপ্যান্ট। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বের হয়ে শুকিয়ে গেছে। আমার ছোটবেলার অভিজ্ঞতায় বুঝলাম সাপে কেটেছে।
বললেন এই সেই মৃতদেহ। আমি বললাম কি করে জানলেন। বললেন ওনার গুরু আগেই বলেছিলেন। সেই মত সব ব্যবস্থা। বললাম ও। আমি বললাম কখন মারা গেছে? এর বাড়ির লোক আসেনি খুঁজতে?
বললেন কাল বিকালে মারা গেছে। লতাপাতা থেকে এরা ওষুধ বানায়। সেই খোঁজে ই ও একদিকে এসেছিল। ওর সাথে যারা এসেছিলো সবাই কাঠের জন্য। তাই ওর হাতে এই হেঁসো। ওর বাড়িতে কেউ নেই। ও অনাথ। গ্রামেই এর ওর কাছে মানুষ। তাই খোঁজ নেবার ও কেউ নেই। ওরা এতো গরিব নিজেদের লোককেও দাহ করতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে যায় মুখে আগুন দিয়ে। আর এমন ক্ষেত্রে তো বলেই দেবে বাঘে খেয়েছে। আপনাকে এতো কথা কে বললেন আপনার গুরুদেব?
বললেন হ্যাঁ। আমার পরকায়াকল্পের কথা তো উনি জানেন। তোমার আসার কথাও। উপযুক্ত দেহ পাওয়া যাচ্ছিলো না। এই ছেলেটি উপযুক্ত কিভাবে হলো? এর আধার খুব ভাল ছিল। দেহ ও সেই ভাবে তৈরী ছিল। কিন্তু ওর স্বল্পায়ু। তাই ওকে ই নির্বাচন করা হয়েছে। এর আগে আমি চেষ্টা করেছিলাম একবার বদ্রীনাথে। গুরুদেবের তেমনই নির্দেশ ছিল। কিন্ত শেষ পর্যন্ত বিশেষ কিছু কারণে সম্ভব হয়নি। বললাম যাক ভালোই হলো আমি দেখতে পাব। হাসলেন। বললেন পায়ের দিকে ধরো তুমি। আমি হাত ধরছি। অনেক কষ্টে ছেলেটির হাত থেকে ওই অস্ত্রটি ফেললেন।
এতটা এমন রাস্তা যাবো কি করে? এই ভাবে ধরে। বললেন কোনো অসুবিধা হবে না। কনকনে ঠান্ডা দেহ। শক্ত হয়ে গেছে অসম্ভব। হালকা গন্ধ বেরোচ্ছে। তুললাম। অর্ধাহারে অনাহারে থাকা দেহ বেশ হালকা। দেখলাম উনি উপরের দিকে চলেছেন, বললাম এদিকে কেন। বললেন একটু চড়লেই আবার উৎরাই। একদম সাপ বেজির জায়গায় গিয়ে পড়ব। কষ্ট কম হবে নামতে। চললাম। ওনার সাথে। একটু এগোতেই একটা জায়গায় বেশ সমতল। উঠলাম। আমাকে বললেন নামও। নামালাম। এবার তুমি সামনে যাও। আমি পিছনে। যেমন পথ দেখছো তেমনি সোজা নামবে। আমি পিছনে পা ধরছি। ঘুরে গেলাম। বেশ খাড়া। চড়াই পথে দ্রুত নামতে লাগলাম। ভার ও কম লাগলো। পথ শেষ। আবার সেই সরু রেখা। বুঝলাম এবার এই জঙ্গলে ঢুকতে হবে।
দাঁড়িয়ে গেলাম। উনি পিছন থেকে বললেন এই রাস্তা ধরে এগোও। আর রাস্তা। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগোনো, আগে তাও দুটো হাত দিয়ে গাছপালা সরাতে পারছিলাম। এখনতো আর পারছি না। তাই ধাক্কা খেতে খেতে যাওয়া। বললেন দাঁড়াও। থমকে গেলাম। বললেন এই সেই জায়গা দেখ। যেখানে দুজন ছিল। নামাও। দেখি সে দুজনের কি হলো? গাছ থেকে একটি ডাল ভেঙে নিয়ে এদিক ওদিক সরাচ্ছিলেন। দেখলাম না কোথাও কিছু নেই। তারপর আবার সেই শাম্ভবী মুদ্রায় চলে গেলেন। খানিকক্ষণ কাটলো। বললেন না ওরা চলে গেছে। বোধহয় এযাত্রায় দুজনে উৎরাতে পারলো। ওনার গুরুর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে বললেন চলো। আবার দেহ ওঠানো হলো।
চললাম। সেই ঝোপঝাড় পেরিয়ে গুহার কাছে পৌঁছাতে প্রায় আরও আধ ঘন্টা নামলো। সেই পরিধির বাইরে বললেন দেহ রাখতে। রাখলাম। ওখানে দাঁড়িয়ে কিছু মুদ্রা করলেন। দুঠোঁট নড়ছে। বন্ধ হলো।
বললেন এস। এবার নিয়ে ভেতরে চল। আমি বললাম আমায় তো আবার ধাক্কা দেবে আপনার পোষ্য। বললেন না। কিছু করবে না। চলো। সহজ ভাবে ভেতরে ঢুকে গেলাম। গুহার বাইরে রাখলাম দেহ। উনি আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে গুহায় ভেতরে ঢুকে গেলেন। নিয়ে এলেন একটি কমণ্ডলু। ঝোরা থেকে জল আনো ভর্তি করে। জল নিতে গেলাম। সেই আবার দেখি গায়ে গায়ে। একটা অস্বস্তি। কেমন অশরীরী অনুভূতি। জল ভর্তি করে নিয়ে এলাম। দেখি মহারাজ ছেলেটি কে সম্পূর্ণ নগ্ন করে ফেলেছেন।
জলভর্তি কমণ্ডলুটা মহারাজের হাতে দিলাম। হাতে নিয়ে বলতে শুরু করলেন
ওঁ গঙ্গে চ যমুনা চৈব গোদাবরি সরস্বতী নর্মদে সিন্ধু কাবেরি জলেহস্মিন সন্নিধিং কুরু ।।
ওঁ কুরুক্ষেত্র গয়া গঙ্গা প্রভাস পুষ্করিণী চ তীর্থান্যেতানি পুণ্যানি স্নানকালে ভবন্ত্বিহ ।।
গোটা দেহটিকে ভালো করে স্নান করালেন। আমাকে বললেন এখন আর তুমি এই দেহ স্পর্শ করোনা। বললাম ঠিক আছে। আমি বললাম বাইরে রাখা কি ঠিক হবে মহারাজ। বললেন না। ব্যবস্থা হবে। আবার জল আন্তে পাঠালেন। জল আনলাম। এবার ও সেই একই মন্ত্র উচ্চারণ করে স্নান করালেন দেহটিকে। এবার বললেন ভিতরে একটি কাপড়ের পুটুলি পাবে বড়ো নিয়ে এস। গুহার ভিতরে ঢুকলাম। দ্বিতীয় অংশে ঢুকে বেশ অন্ধকার। তাই পকেট থেকে দেশলাই বার করে প্রদীপ জ্বালালাম। প্রদীপের আলোয় একটু ধাতস্থ হলাম। প্রদীপের পরে গুহার একদম শেষ প্রান্তে পেলাম এক বিরাট পুটুলি। তাকে তুলে কোনো মতে নিয়ে এলাম বাইরে। মহারাজ খুলে একটি কাপড় বার করলেন। সাদা নতুন কাপড়। খুব বড়ো নয় মাঝারি মাপের। তাই দিয়ে দেহটিকে ভালো করে মুছলেন।
এবার ওই পুটলি থেকে একটি বোতল বার করলেন। তারপর তার ভিতরের তরল টি হাতে নিয়ে গোটা গায়ে মাখালেন ছেলেটির। একটা সুন্দর গন্ধে জায়গাটি ভোরে গেল। কেমন চাঁপা ফুলের গন্ধ। আমাকে বললেন ভিতর একটি নতুন কম্বল আছে নিয়ে এস। আবার খুঁজে আনলাম ভিতর থেকে। একটি কাগজের মধ্যে মোড়া সেটি। একটু দূরে কম্বলটি পাতলেন। দুহাতে ছেলেটিকে তুলে শুইয়ে দিলেন ওই কম্বলে। তারপরে কম্বল টেনে ঢোকালেন গুহায়। ধুনীর পাশে এনে রাখলেন দেহ সহ কম্বল। আমায় বললেন বাইরে বাকি সব ফেলে দাও। বললাম কমণ্ডল? বললেন না ওটা আর পুটুলি নিয়ে আসবে। ওই বোতল ফেলে দেবে। ফেলার পরে স্নান করে নেবে। কমণ্ডলু ধুয়ে নিয়ে আসবে। আর পুটুলি বেঁধে ভেতরে নিয়ে রেখে দাও। ওখান থেকে একটি ধুতি নিয়ে পরে নিও স্নানের পর।
করে ফেললাম আজ্ঞা মতো। জামা কাপড় বাইরে একটি পাথরের ওপর রেখে স্নান করলাম। জামা কাপড় ও ধুয়ে দিলাম। বাইরে একটি বড়ো পাথরের ওপর ভিজে জামা কাপড় রেখে দিলাম। বাকি সব ভিতরে নিয়ে গেলাম। দেখি উনি ধুনি জ্বালিয়ে ফেলেছেন। আমায় বললেন যাও এবার বস। তুমি একটু রিলাক্স করে নাও। এর পরে তোমার কাজ আছে কিছু। তবে আমার কাজ দেরি আছে।
একটু বসে সিগারেট ধরাবো কি না জিজ্ঞেস করলাম। বললেন কোনো কিছু তেই অসুবিধা নেই তোমার। তবে আমি খাব না।
সিগারেট ধরিয়ে বসব ভাবছি এমন সময় বললেন বাইরে যাও। দেখ তোমার জন্য চা আর বাদাম এসে গেছে। নিয়ে এস। আমি উঠব না বলে তোমাকে বললাম।
আবার উঠলাম চা আনতে। বাইরে গিয়ে দেখি এক কাপ চা সঙ্গে কিছু বাদাম। নিয়ে ভেতরে এসে বসলাম। বললাম মহারাজ অনেক ধন্যবাদ। কি বলে যে কৃতজ্ঞতা জানাই। এই দুর্গম জায়গায় আমি তো রাজার হালে। ভেবেছিলাম কদিন কিছুই জুটবে না। হয়ত ফলমূল খেয়ে কাটাতে হবে। হাসলেন। বললেন তা কেন তুমি তো নিজে আসোনি। আমি তোমায় অতিথি করে এনেছি। তোমার খেয়াল তো আমায় রাখতেই হবে।
বললাম আচ্ছা আমি তো কলকাতার ছেলে। দ্বাদশ পরিক্রমা তো আমি দেওঘর বা কাশী থেকে করতে পারতাম। কিন্তু এখান দিয়েই বা কেন আর এতো কিছু ঘটলো ই বা কি করে।
বললেন তোমার এখানে আসা পূর্বনির্ধারিত ছিল না। শুধু আমার প্রয়োজনে তুমি এসেছো। আমরা একই গুরু পরম্পরার। তাই তোমাকে পেলে আমার সুবিধা হয়। গুরুদেব তাই ব্যবস্থা করেছেন।
এখন বুঝবে না। পরে জানবে। তোমার আর কি কি প্রশ্ন আছে। বললাম সেতো অনেক কিছু মহারাজ। আমার তো কেমন লাগছে পুরো ব্যাপারটা। উত্তেজনা আর ধৈর্য্য ধরতে পারছি না। বললেন প্রথম জানছ, দেখছো তো তাই এমন হচ্ছে। ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা ওই দেহে যাবার পর আপনি আমায় চিনতে পারবেন। বললেন সবই এক থাকবে। শুধু দেহ টি আলাদা। আপনার মস্তিষ্ক ও তো আলাদা হয়ে যাচ্ছে। কিভাবে চিনবেন। বললেন তোমরা hard disk crash করলে বা নতুন hard disk লাগালে যেভাবে data restore করো তেমনি হয়ে যাবে।
আচ্ছা আপনি তো উত্তর ভারতীয়। এ ছেলেটি তো দক্ষিণ ভারতীয়। আপনার পরিচিতরা তো কেমন করে চিনবেন। কারো চেনার তো দরকার নেই। গুরু চিনবেন। আর যারা এই জগতে উচ্চ স্তরে আছেন। তারা মন তরঙ্গ পাঠাবেন ঠিক বুঝে যাবেন।
কিছুটা tan হয়ে গেলো। এন্টেনা সব টা নিলো না। বললাম আপনি আমায় চিনতে পারবেন? বললেন হ্যাঁ। এক কাজ করো তো, বললাম কি কাজ? দেখ চিতা সাজানো হয়েছে কিনা। যক্ষ সব ঠিক মতো করেছে কিনা! ভিরমি খেয়ে পড়ার এটাই বোধহয় বাকি ছিল। আমি দেখতে গেলে সে শুনবে কেন? আর যদি ভুল করেও আমি ঠিক করতে গেলে যদি ঘাড়টাই মটকে দেয়?
ওকে বলে দিয়েছি। তোমার কিছু ভয় নেই। সেতো বললেন তারপর এই যে আপনি দেহ পরিবর্তন করছেন তারপর সে আপনার নতুন শরীর চিনতে পারবে না। আমার ঘাড়ে উঠবে। শুনেছি যক্ষ নাকি একবার ঘাড়ে চড়লে আর নাম না। মরলেও কাজ বাকি থাকলে সেই দেহ তে ঢুকে পড়ে। ও বাবা। আপনি কি ওকে আমার ঘাড়ে দেবেন ঠাওরেছেন?
সোমসুন্দরজীর অট্টহাস্যে গুহা গমগম করতে লাগলো। বললেন ও আমার সাথেই থাকবে। না হলে আমার এই কিশোর শরীর কিভাবে রক্ষা পাবে। আর ও আমার সাথে বহু বছর আছে। এখন দেরি করো না। গিয়ে দেখে আসো সব ঠিক হয়েছে কিনা।
আমার দিদিমার মৃত্যু গ্রামে হয়েছিল। তখন কাঠের চিতা একবার দেখেছিলাম। সেসব কি আর মনে রেখেছি কি ঠিক কি ভুল। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম ডান দিকে একটি জায়গা পরিষ্কার পরিছন্ন করা। সেখানে জঙ্গলের কাঠ দিয়ে চিতা সাজানো হয়েছে। পাশে কিছু সামগ্রী যেমন মাটির হাঁড়ি, পাটকাঠি, ধুপ ইত্যাদি। নিখুঁত আয়োজন।
ফিরে এলাম গুহায়। মহারাজ কে বললাম এতো নিখুঁত আয়োজন। কিন্তু আমি একা দেহ তুলবো কি করে ওই চিতায়। বললেন তুমি চিন্তা করো না। সব শেষের পর এক বৃদ্ধ ও এক যুবক আসবেন। তুমি দুজনকে প্রণাম করবে। পায়ে হাত দিতে যাবে না আর তাদের ছুঁতে যাবে না। দূর থেকে প্রণাম করবে। মাথা নাড়লাম। মুখাগ্নি তুমি করবে। বৃদ্ধ তোমায় সব বলবেন। তেমন তেমন করবে। তারা জানবে কি করে? এখানে এসব হচ্ছে। তারা সব জানেন। ঠিক সময়ে আসবেন। বৃদ্ধ আগে আসবেন।
কিছু খাবে? অনেক ক্ষণ তোমার তো খাওয়া হবে না। বললাম খিদে নেই। তবে বার কতক চা লাগবে মহারাজ। কোথাও যেন সম্পর্কটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। উত্তেজনা কাজ করছে মনে। সম্মান ও আছে আবার এক অসমবয়সী বন্ধুত্ব।
বললেন জানি। চা আসবে তোমার বারে বারে। এখন আর কি প্রশ্ন? আমার কি আর প্রশ্নের শেষ আছে? আমি তো করেই চলেছি। সেসব আর লিখলাম না। এর মধ্যে চা এলো বার কতক। ঘড়িতে যখন ঠিক সাড়ে বারোটা মহারাজ ধুনীর সামনে স্থির হয়ে বসলেন। ঋজু মেরুদন্ড। দেখলাম একটি পাত্রে ঘি আছে। ঘি টা গরম করলেন ধুনীর আগুনে। আমায় বললেন তোমার খাতা বার করে দূর্গা সপ্তসতী বীজমন্ত্র পাঠ শুরু করো। বুঝলাম এটাও জানা। খাতা বার করলাম পাঠ শুরু করলাম। উনি ধুনি তে ঘি দিলেন। মনে হলো ওটাই যেন হোম কুন্ড। প্রায় এক ঘন্টা চললো হবন। শেষ হলো। দেহ টি ওভাবেই পড়ে আছে। এমন সময় এক অতি বৃদ্ধ মানুষ গুহা মুখে এলেন। বৃদ্ধ হলেও সুঠাম চেহারা। একদম সোজা। কিন্তু মুখের চামড়া কুঁচকে গেছে। হাতের পায়ের ও। গায়ে গেরুয়া কাপড় জড়ানো। ধীরে ধীরে ভিতরে এলেন। ঢুকলেন গুহায়। আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মহারাজ। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন। দেখাদেখি আমিও তেমনই করলাম। আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুললেন। কারো মুখে কোনো কথা নেই। উনি চুপ। দুজনে একই কম্বলে বসলেন মুখোমুখি। দুজন দুজনের দিকে চেয়ে। কারো কোনো পলক পড়ে না। বুঝলাম কোনো উচ্চ স্তরের মহাত্মা। প্রায় ১৫-২০ মিনিট। উনি উঠে বেরিয়ে গেলেন।
এবার মহারাজ বললেন তুমি ধ্যানে বস। মহামৃত্যুঞ্জয় করবে। সেকি আমি দেখবো না। চোখ চেয়ে করবে বেশ কঠিন কণ্ঠে বললেন। কোনোদিন তো এমন করিনি। তবু শুরু করলাম। খুব কঠিন মনসংযোগ আনা। আবাহন করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হলো সে কথা লিখতে পারবো না। শুরু করলাম। মহারাজ এক নিমগ্ন স্থিতিতে। স্বাস ক্রমশ কমে আসছে। আরও স্থির হচ্ছেন। খানিকক্ষণ পর শ্বাসের ওঠানামা একদম বন্ধ হয়ে গেলো। একদম স্থির হয়ে গেলেন। একবার ওনাকে দেখছি আবার দেহ টিকে দেখছি। মুখে মন্ত্র চলছে। অবিরাম জপ কিন্তু কোনো ফিলিংস নেই। মনে হলো মড়াটা নড়ে উঠলো। হৃদপিন্ডটা যেন বুকের ভেতর থেকে আমার গলায় চলে এল। প্রানপনে জপ করছি।
দেহটি দেখছি আর মহারাজকে দেখছি। মৃত বাচ্চাটির ওই শক্ত কাঠ দেহর কেমন পরিবর্তন ঘটছে। আমি কি ঠিক দেখছি। জপ চলছে। কেমন যেন দেহ স্বাভাবিক হচ্ছে। ২০ঘন্টা প্রায় দেহ পড়ে আছে। তাতে রক্ত সংবহন কি ভাবে সম্ভব? নিজেকে নিজে বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
সোমসুন্দরজীর দেহ নিশ্চল। না কোনো শ্বাস নেই। নির্দেশ মতো মন্ত্র জপ করে যাচ্ছি। এদিকে এই কিশোরের দেহ যেন ক্রমে স্বাভাবিক হচ্ছে। হটাৎ দেহ সোজা হয়ে উঠে গেলো। কোমর থেকে সোজা। সেই রিগর মর্টিস এ যেমন হয়। চিতায় দেহ সোজা হয়ে যায় তেমনই। চোখ বন্ধ। টানটান পা। হালকা পেটের ওঠা নামা। বুঝলাম শ্বাস চালু হয়েছে। কিন্তু ওই বসাটাই আমার কাছে কেমন যেন ভয়ের লাগছে। ধীরে ধীরে দেহটি স্বাভাবিক হতে লাগলো। মহারাজের দেহ একদম স্থির। চোখ বন্ধ। খুব ধীরে ছেলেটি চোখ খুললো। এবার মনে হলো দ্রুত স্বাভাবিক হচ্ছে। এক অনিন্দ্য সুন্দর যুবক গুহার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে ভিতরে এলো। ছেলেটির মুখোমুখি এসে বসলো। ছেলেটি চোখ খুললো সম্পূর্ণ। যুবক নমস্কারের ভঙ্গিমায় বসে রইলো। এখন বেশ স্বাভাবিক। প্রতিনমস্কার করলো ছেলেটি। সেই লোলচর্ম বৃদ্ধও আসলেন। জপ আমার বন্ধ হয়ে গেছে। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছি। মনে হচ্ছে চোখের পাতা ফেললেই বোধ হয় কিছু miss হয়ে যাবে। আমি এখানে কিছু ছাড়তে চাই না। সমস্ত ঘটনা আমার কাছে অমূল্য। এদৃশ্য দ্বিতীয়বার রিপিট হবে কিনা জীবনে জানি না। তাই সব চেটে পুটে অনুভব করে নিতে হবে।
সেই অতি বৃদ্ধ দেহ এসে ছেলেটির মাথায় হাত রাখলেন। চোখ বুজলো ছেলেটি। কয়েক মিনিট। হাত তুলে নিলেন সেই বৃদ্ধ সন্ন্যাসী। ছেলেটি এবার উঠে বসলো। মাথা নামিয়ে মাটিতেই প্রণাম করলো। উঠে দাঁড়ালো। সেই যুবা পুরুষকেও দেখলাম একই রকম করতে। আমিও দেখাদেখি তাই করলাম। কোনো কথা নেই। প্রণাম করতেই সমগ্র শরীর মন এক অনাবিল আনন্দে ভোরে গেলো। উঠে দাঁড়ালাম। পায়ে যেন কোনো শক্তি নেই।
ছেলেটি আমার দিকে চেয়ে বললো তোমায় অনেক কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি সোমসুন্দর। আমি বললাম প্রণাম মহারাজ। কিসের কৃতজ্ঞতা। আমার অপার সৌভাগ্য যে আজ আমি এই ঘটনার সাক্ষী। আপনি দয়া করে আমাকে নির্বাচন করেছেন। নিজেরই কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। একটি ১২ কি ১৩ বছরের ছেলে কেমন অদ্ভুত ভাবে কথা বলছে। তাও তাকে সোমসুন্দরজী মনে করেই কথা বলছি। অথচ সোমসুন্দরজীর দেহ পাশে নিষ্প্রাণ নিশ্চল হয়ে আছে।
ছেলেটি বললো বাকিরা এখানে কেউ তোমার সাথে কথা বলতে পারবে না। সমস্ত পর্ব শেষ। এবার দেহ ওই যুবা তুলে নেবে, একাই। তুমি শুধু দেখ।
কথা বোধহয় শেষ ও হলো না। সেই সুপুরুষ যুবক দেহ তুলে নিল সোমসুন্দরজীর। বসা অবস্থায় দুহাতে। যেন হালকা একটি বাক্স তুলেছে এমনি ভাব। আমরাও তার সাথে বাইরের দিকে এগোলাম। চিতায় তোলা হলো দেহ। ওপরে আরও কাঠ চাপানো হলো যাতে দেহ পড়ে না যায়।