Aবং হলো ১৯৮০ সাল থেকে তার সাধনার জীবনের নানা কাহিনীকে তুলে ধরা। পূর্ব জীবনকে জানার জন্য অবধূত নানা কাজের সূত্রেও সেই সব জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন সঙ্গে মিলিয়ে নিলেন নিজের জীবনের ছন্দকে। অবধূতের জীবনের নানা ঘটনাকে তুলে ধরা হবে এই Aবং বিভাগে। তাঁর শ্রীশৈলম ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এখানে দেওয়া হলো পর্বে পর্বে। আজকে সপ্তম পর্ব।
নৌকা নিয়ে ফিরে যেতেই বুক টা কেমন ধড়াস করে উঠলো। এই নৌকাটা যেন কোথাও একটা ভরসা ছিল। সেটাও চলে গেলো এমন মনে হলো।
আমার হাতটা ধরে উনি চললেন সেই ভাঙা চোরা পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে। খুব ছোট ও নয় আবার খুব বড়ো ও নয়। মনে মনে বোঝার চেষ্টা করতে চাইলাম কোনদিকে এলাম? মন্দিরকে কেন্দ্র করে আমাদের গতিপথ বোঝার চেষ্টা করতে গেলাম।
উনি হেসে বললেন বোঝার যে চেষ্টা করছো ভুল করছো। এ জঙ্গলে তোমার মতন শহুরে লোকের দিক ঠিক করা অসম্ভব। ভয় নেই আমি তোমার সঙ্গে আছি। গুরু ছাড়া তোমার তো আর কোনো সাধুসঙ্গ সেভাবে হয়নি। আর এজগৎ সম্বন্ধে খুব কিছু জানো না। সবই বইপড়া কিছু তথ্য।
আমি না কেমন অস্থির এবং বিরক্ত হয়ে উঠছি মনে মনে। প্রথম প্রথম একটু বিস্ময় থাকলেও কেউ যদি আপনার সব জানে এবং আপনার privacy space এ বারবার চলে আসে যেমন একটা অস্বস্তি হয়, বিশেষ করে মানুষটি যখন অনেকটাই অপরিচিত। আমার ও ঠিক তেমনই অবস্থা।
এসব জগৎ আমি জানতে চাই। কিন্তু তার তো কোনো মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আসিনি। ফলে আরও কেমন একটা লাগছে। এসেছিলাম জ্যোতির্লিঙ্গ দেখবো বলে। দেখবো ঘুরবো আবার সাধনা করবো। কিছু অনুভব করার চেষ্টা করবো। কিন্তু যা ঘটছে বা একের পর এক ঘটে চলেছে তা মাঝে মাঝে কেমন একটা চাপ তৈরী করছে।
দুজনেই এগোচ্ছি দুপাশে ঘন জঙ্গল বাড়ছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। নানা পোকা মাকড়ের ডাক আর কিছু পাখির ডাক ছাড়া নিস্তব্ধই বলা চলে।
নিস্তব্ধতা ভাঙলো সন্ন্যাসীর কোথায়। আমি তোমার কাছে অপরিচিত হলেও তুমি আমার কাছে অপরিচিত নয়। হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিলাম। বলে কি। এমন কথা তো আমার গুরু অবধূত ও কখনো বলেনি। ইনি হটাৎ এমন বললেন।
তোমার জন্মের কিছু পরে তুমি যখন তোমার মাতুল গৃহে ছিলে তখন দেখতে গেছিলাম তোমায়। আমার পোশাক ছিল কালো। গলায় রুদ্রাক্ষ ছাড়াও অনেক মালা ছিল। গায়ে ভষ্ম মাখা। তোমার মা ভয় না পেলেও তোমার দিদিমা খুব ভয় পেয়ে গেছিলেন। তাড়াতাড়ি তোমায় ঘরে নিয়ে যান।
আমি একথা শুনেছি মায়ের কাছে। তখন কিছু জিনিস তোমার মাকে বলেছিলাম এবং তোমার জন্মগত রাজ্ তিলক কপালে যা আছে সে নিয়ে কিছু কথা বলছিলাম। তোমার দিদিমার অতিরিক্ত ভয়ের কারণে আমি কথা শেষ করতে পারিনি। সেই কাজ গুলো করলে তোমার মঙ্গল হতো। আমি ভিক্ষা করতে যাইনি। অদৃষ্ট একেই বলে। কোনো কিছুই করলো না।
বললাম মায়ের কোনো কিছুই মনে ছিলোনা। শুধু একটি কথা ছাড়া। হ্যাঁ জানি বললেন সন্ন্যাসী। আমি সন্ন্যাস বলতে যা বোঝায় সেভাবে সন্ন্যাস কখনো নিইনি। কাজগুলো করলে তোমার এই জীবনে এতো ঘুরে মরতে না।
অনেকটা ভেতরে এলাম ওদিকে আগে যে রাস্তার চিহ্নটুকু ছিল তাও ক্রমে সরু একটা রেখায় পরিণত হয়েছে। ওই দাগটাই যেন রাস্তা। সবে পা ফেলতে যাবো হাত দিয়ে আটকালেন সন্ন্যাসী। আঙুলের ইশারায় চুপ করতে বলেই অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে ওই আঙ্গুল দিয়ে একটা ভার্চুয়াল বৃত্ত আঁকলেন আমাদের চারদিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম সামনে দাঁড়িয়ে এক সাপ। অনেকটা উঠে দাঁড়িয়ে সে। হাড়হিম হয়ে গেলো। তখনো আবছা আলো আছে। সাপটা আমাদের খানিকক্ষন দেখলো ফণা নামিয়ে শুয়ে রইলো। আমরাও দাঁড়িয়ে। পা মনে হচ্ছে যেন কেউ মাটিতে সিল করে দিয়েছে। কপালের পাশ দিয়ে শির শির করে ঘাম নামছে।
সন্ন্যাসী বললেন খুব আস্তে আস্তে। ও আমাদের কাছে এগোতে পারবে না। সেই ব্যবস্থা করেছেন। এদিকে আমরাও তো এগোতে পারছি না। সাপটা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো পাশের জঙ্গলে।
সন্ন্যাসী আবার একই রকম করলেন। বললেন চল। এগোলাম। জিজ্ঞেস করলাম কি করলেন মহারাজ। বললেন চারদিকে একটা বন্ধন দিয়েছিলাম। আসলে আমাদের পায়ের শব্দে ও ভয় পেয়ে যায় তাই। ও রাস্তা পার হবার জন্য এগোচ্ছিল।
বন্ধন কি করে দিতে হয় মহারাজ? আমি জানতাম তুমি এটাই জিজ্ঞেস করবে। এবিদ্যা আমি তোমাকে শেখাবো না। যিনি শেখাবেন তিনি নর্মদা তে থাকেন। তোমার দেশেরই মানুষ। তবে দেরি আছে অনেক।
এগিয়ে চললাম ওই সরু দাগ বরাবর। আরও প্রায় ঘন্টা খানেক ওই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। অর্কদেব পুরোপুরি অস্ত গেছেন। পকেট থেকে টর্চ ও বার করতে দেননি মহারাজ। উনি আগে আমি পেছনে। আমার হাতটা ধরে রেখেছেন উনি। কোথা দিয়ে যাচ্ছি তা প্রায় নিজেই জানি না। এসে পৌছালাম এক জায়গায়। মশাল জ্বলছে বেশ কয়েকটা। কয়েকটি মানুষকে দেখলাম ওই মশালের আলোয়। একটা বড়ো বট গাছ। তার তলায় একটা ছোট ঝুপড়ি মতো। সবই আবছা আলোয়। মশাল গুলোই যেন বাউন্ডারি জায়গাটার। মশাল গুলো যে খুব জোরালো আলো দিচ্ছে তাও নয়। আমরা যেতেই সবাই সমস্বরে নমঃ নারায়ন বলে উঠলেন।
মহারাজও একই কথা বলে প্রত্যুত্তর দিলেন। আমরা এগিয়ে গেলাম ওই ঝুপড়িটার দিকে। একটু এগোতেই দেখি হাড়িকাঠ। পিলে চমকে উঠলো। বুঝলাম এই সেই কালী মন্দির যার কথা মহারাজ বলেছিলেন। বেশ কয়েক বার ইষ্ট নাম জপে নিলাম মনে মনে। চমকানিটাই বুঝিয়ে দিলো আমি মহারাজকে পুরো বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি। হয়তো ভয় কিছুটা কমেছে, বিশ্বাস ও বেড়েছে তবুও সেটা কমপ্লিট নয়।
মহারাজ কিন্তু হাত ছাড়েননি আমার। একই ভাবে বজ্র মুঠিতে ধরা হাত। ঝুপড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। বললেন জুতো খুলে নাও আর ভিতরে এস। জুতো খুলে মাথা নিচু করে ভিতর ঢুকলাম। ফুট দেড়েক হবে কালী মূর্তির। মূর্তি দেখে একটু চমকালাম। কারণ এখানে এ ধরণের মূর্তি দেখবো ভাবিনি। মূর্তির গড়ন আমাদের বঙ্গদেশীয় কালী মূর্তির তবে মুখ অনেকটা চামুন্ডা মূর্তির মতো। একটা ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে ডানদিকে। মূর্তির রং কালো।
মহারাজ প্রণাম করতে বললেন। বসলাম। মহারাজ হাতে একটি জবা ফুল দিলেন শুরু করলেন ওম জয়ন্তী মঙ্গলা কালী .......
ফুল টি মায়ের পায়ে দিলাম। বললেন চোখ বন্ধ করে আসনে বস। পিঠের ব্যাগ পাশে নামিয়ে রেখে আসনে বসলাম। বললেন আগে গুরু আবাহন ও ধ্যান করে নাও। গুরু ধ্যান হলো। উনি একটি মন্ত্র বলতে শুরু করলেন। ওনার সাথে ই মন্ত্র বলতে লাগলাম। এই মন্ত্র আগে সেভাবে শুনিনি। যদিও আমি আর কতটুকু জানি। শেষ হলে বললেন প্রণাম করে তোমার মনস্কামনা জানিয়ে বাইরে এস। আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি।
প্রণাম করে উঠে মনস্কামনা জানিয়ে বাইরে এলাম। ব্যাগ বার করে পিঠে নিয়ে দেখলাম মহারাজ দাঁড়িয়ে আছেন। ওনার সামনে এক কাষায় বস্ত্র পরা একজন দাঁড়িয়ে খুব সৌম দেখতে। মাথায় ও একটি কাষায় বস্ত্র পাগড়ির মতো করে পরা। মহারাজের সাথে কথা বলছে।
মহারাজের পাশে এসে দাঁড়াতে বললেন নমঃ নারায়ণ। আমি ও নমস্কার করে প্রত্যুত্তর দিলাম। হিন্দিতেই বললেন তোমার কথা শুনলাম। এই স্থান সম্পূর্ণ বাম মার্গের। যদিও তুমি এই মার্গের নয় তবুও এই মার্গ সম্বন্ধে তোমার কিছু অভিজ্ঞতা হবে কিন্তু অনেক কিছুই বুঝবে না। দেবী এখানে নয়টি মুন্ডের ওপর অধিষ্ঠিত। বহু প্রাচীন এই মূর্তি। কবে এবং কে স্থাপনা করেছেন জানা নেই। কাপালিকারা আসেন এখানে। আজও এখানে নরবলি হয়। তবে খুব কম। তবে এস ডান দিকে বলে মন্দিরের ডান দিকে নিয়ে দেখালেন পাথরের এক বিশাল ভৈরবী চক্র। এই স্থানে ভৈরবী সাধনা হয়। যা তুমি কখনো হিমালয়ের গভীরে দেখবে। আর পাবে নর্মদার শূলপানি জঙ্গলে। তোমার বাংলায় আগে খুব ভালো ব্যবস্থা ছিল এখন সঠিক পথে দু একটি জায়গায় আছে। বেশিরভাগ প্রাচীন চক্র নষ্ট হয়ে গেছে। পাণ্ডবেশ্বরএর কাছে ছিল।
বুঝলাম ইনি ভালোই ঘোরেন। আমি এই জায়গার দ্বায়ীত্বে আছি এখন। পরে যেমন নির্দেশ আসবে তেমন করবো। বললাম কতদিন আছেন এখানে। বললেন প্রায় ১০বছর। চলো আরও একটা জায়গা দেখাই। নিয়ে গেলেন মন্দিরের বাম দিকে ওখানে একটা বেশ বড় বেদি। সেখানে সামনে দাঁড়িয়ে বললেন প্রণাম করো। করলাম। বললেন এক সিদ্ধ সাধকের পঞ্চ মুন্ডির আসন এটি। এখনও এখানে সাধক সাধিকা পঞ্চ ম কারের সাধনা করেন।
তোমার যা পথ সেখানে অনেকটা কিছু গুরু করে দিয়েছেন। তুমি খুব ভাগ্যবান যে এই জীবনে গুরু দ্বারা শক্তিপাত, প্রাণপাত, শিবপাত এর মাধ্যমে দীক্ষা পেয়েছো। খুব কম মানুষ এমন পায়। সবাইকে বীজ মন্ত্র দীক্ষার পর নিজেকে চেষ্টা করে এগোতে হয়। অনেক পরে গুরু শক্তিপাত করেন। আর তুমি শুরুই করেছো সব কিছু নিয়ে।
সবাইকে যে যেপথে আছে তাকে সেই আত্মজ্ঞান এর জন্য অদ্বৈততেই উপনীত হতে হয়। একদম শেষের পথে তুমি শুরু করেছো কিন্তু সঙ্গে দক্ষিণমার্গে তন্ত্র সাধনাও করছো।
দেখে ফিরে এলাম মহারাজের কাছে। একটু দূরে কিছু মানুষ বসে আছেন। আর একটি দিকে দুজন। এমনই ছন্ন ছাড়া। উনি বললেন এখানে এখন যাঁরা এসেছেন তারা সব অন্য জায়গা থেকে। এদের বহু বছরের সাধনা। আজ রাতে কিছু দেখতে পাবে।
তোমার কিছু কৌতূহল যেমন মিটবে তেমন অনেক প্রশ্ন ও নতুন কৌতূহল ও আসবে যার উত্তর এখানে পাবে না।
কবে পাবো তাহলে? দেরি আছে। এরকম গা ছমছমে পরিবেশে আমার একটা কথাই মনে এলো 'কপালকুন্ডলা' র কথা। আগে ভাবছিলাম এখানে বোধহয় সব কাপালিক। তাই জিজ্ঞেস করলাম বাকি যারা আছেন তারা কি কাপালিক। হেসে বললেন না। এখানে কেউ কাপালিক নন। সত্যিকারের কাপালিক যারা আসেন তারা আগে জানান দেন। তখন এই মঠে কেউ থাকবে না। এমন কি আমি নিজেও থাকি না।
আচ্ছা কাপালিক কারা? খুব সাধারণ ভাবে বলতে পারো শৈব তন্ত্রের একটি শাখা। এঁরা কপাল নিয়ে ঘোরে। মানে মানুষের মাথার খুলির অর্ধেক অংশ বা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কপাল অবধি। সেই থেকে এঁরা কাপালিক। এব্যাপারে একটি বই তোমার নোটবুকে লিখে নাও পরে পড়ে দেখ অনেক কিছু জানতে পারবে।
আবার চমকাবার পালা। ও দেখি সব জেনে বসে আছে। জিজ্ঞেস করেই ফেললাম আপনি জানলেন কি করে আমার কাছে নোটবুক আছে? আর আপনারা জানেনই বা কি করে? বলবো আগে লেখো বইটি নাম। এক সাহেবের লেখা। তবে অনেকটা উনি লিখেছেন। পিঠের ব্যাগ নামিয়ে পকেট থেকে নোটবুক আর পেন বার করলাম।
সন্ন্যাসী মহারাজ হাঁক পাড়লেন কি করছো বলে। আমার কিছু বলার আগেই মঠাধ্যক্ষ বললেন হিন্দিতে তোমার সাংবাদিক বন্ধু নোট নিচ্ছেন। আবার চমক। উনি জিজ্ঞেস করলেন বাংলায় আমাকে। ইনি কি করে বুঝলেন। আমার অমন ভ্যাবলার মতো চেয়ে থাকা দেখে আন্দাজ করলেন বোধহয়। বললেন আমার গুরু বাঙালি। আমার অনেক গুরুভাই ও বাঙালি। তোমার দেশের ভাষা আমি জানি। আসলে বাংলায় তন্ত্রশাস্ত্র অত্যন্ত উন্নত। বেশির ভাগ বড়ো তন্ত্র সাধক বাংলার। অনেকে এখন দেহে নেই তবে সূক্ষ্ম দেহে আছেন এবং আসেন।
জিজ্ঞেস করলাম আপনার গুরুর নাম। বললেন সব কিছুর উত্তর পাবেনা। তুমি যখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত হবে তখন জানিয়ে দেব। বুঝলামনা মহাত্মা, বললাম। তুমি এখনো প্রস্তুত নয়। বহু ঘোরা তোমার বাকি। সবে শুরু। বহু জানার বাকি। আগে নিজেকে তৈরী করো। আমি আপনাকে কোথায় পাব? সময় হলে আমি তোমায় নিজে গিয়ে জানিয়ে আসবো।
আগে লিখে নাও নাম টা। ইনি মেক্সিকোর মানুষ। বললেন The Kāpālikas and Kālāmukhas by David Lorenzen. লিখে নিয়ে নোটবুক পকেটে ঢোকালাম।
উত্তেজনার পারদ কেমন চড়ছে। এবার তোমার পরের একটি প্রশ্নের উত্তর দেব। আমরা কি করে বুঝছি তোমার অবস্থা। তোমার কাছে খুব রহস্য। তাই না। third eye open, এমন নয়। একে অনেকটা তুমি clairvoyance বলতে পারো। A perception through extrasensory about anything. কিছু শ্বাসের ক্রিয়া গুরুর নির্দেশিত পথ এবং গুরুর তত্ত্বাবধানে থেকে যদি নিয়মিত অভ্যাস করো এক সময়ে তুমিও এমন clairvoyance পাবে।
জিজ্ঞেস করলাম কি করতে হয়। বলতে পারি কিন্তু করবে না কথা দিতে হবে। কারণ ভুল হলে তোমার মৃত্যু ও ঘটে যেতে পারে। নিজে নিজে করতে যেওনা। বললাম আচ্ছা। কারণ শুধু গুরু নির্দেশিত পথ নয় তার তত্ত্বাবধানটাও খুব দরকার শুরুর দিকে।
খাতা পেন বার করে লিখতে বসলাম।
এই জায়গার পর এখানে আলোচনা করলাম না। পরে কখনো জানাবো।
লেখা শেষ হলো। ভাবতে কেমন লাগছে কত সহজ। অথচ কত কঠিন। না কঠিন হলো ঠিক মতো করছি কিনা। বললেন তোমার গুরু এই অনুমতি দেবেন কিনা জানি না। কারণ তোমাদের পথে সবটাই সাধনা নির্ভর। প্রাণক্রিয়া প্রায় নেই বললেই চলে। আসলে তোমার পথে লোক খুব কম। দ্বৈত আচারে অনেক বেশি। দত্তাত্রেয়র দেখানো যত পথ আছে তারমধ্যে তোমাদের পথ একটি এবং সেখানে পুরোটাই গুরু নির্ভর। যেমন ঋষি অগস্ত্যকেও তোমার বিদ্যায় সিদ্ধ হতে মাতা লোপামুদ্রাকে গুরু হিসাবে নিতে হয়েছিল। অথচ এই লোপামুদ্রাই একদিন ঋষি অগস্ত্যর শিষ্যা হয়েছিলেন। মনে পড়ে গেলো অনেক কথা এব্যাপারে।
সিগারেট ধরাবো কিনা জিজ্ঞেস করলাম। বললেন এখানে ওসব কোনো আচার নেই। খেতে পারো। এখানে আরও পাঁচ জন মাতা আছেন। একটু পরে আসবেন। ধুনি প্রস্তুত হচ্ছে।
কিছু খাবে? বললাম চা হলে ভালো হতো। চা পাবেন না। তবে একটি ঐরকম কিছু ভেষজের ফোটানো জল আসবে। তান্ত্রিক মায়েরা আনবেন। ভালো লাগবে। আজ তোমার শঙ্খিনীর অভিজ্ঞতা হবে। রাতে দেব। বেশ ভালো ঠান্ডা লাগছে তখনি। ব্যাগ থেকে চাদর টা বার করে গায়ে দিলাম।
সিগারেট বার করলাম ওনাকে দিলাম আর সন্ন্যাসী মহারাজ কে ডাকলাম নেবার জন্য। ইতিমধ্যে চোখে পড়লো জায়গাটার মাঝখানে ধুনীর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।
তিনজন মহিলা হাতে কিছু নিয়ে আসছেন আবছা অন্ধকার থেকে। মশালের আলোয় ক্রমে পরিষ্কার হচ্ছে। সম্পূর্ণ কাষায় বস্ত্র মনে হলো। একজনের মাথায় বড়ো জটা। উঁচু করে বাঁধা। হাতে একটা পেল্লায় কমণ্ডলু। বাকি দুজনের একজনের হাতে একটা তামার থালা। তাতে ছোট ছোট পাত্র। সেগুলি পাথরের। অনেকটা গ্লাসের মতো।
ধুনি সাজানো সম্পূর্ণ। ওখানেই এলেন ওনারা সব নিয়ে। তারপর যিনি কমণ্ডলু নিয়ে ছিলেন আর মঠাধক্ষ্য দুজনে এগিয়ে গেলেন ওই দেবী মন্দিরের দিকে। ভেতরে ঢুকে গেলেন। আমার সঙ্গী সন্ন্যাসী মহারাজও আমায় ইশারায় ডেকে এগিয়ে গেলেন মন্দিরের দিকে। গেলাম।
মাকে ওই চা একটা পাথরের গ্লাসে নিবেদন করা হলো। সবাই হাত জড়ো করে কিছু একটা বললো। যা আমার বোধগম্য হলো না। হাঁটু মুড়ে বসে মাথা নিচু করে সবাই প্রণাম করতে বসলো। দেখা দেখি আমিও বসলাম। উঠে সবাই বেরিয়ে এলাম।
ধুনীর কাছে এসে মাটিতে রাখা হলো। মাটি না বলে পাথর বলাই ভালো। সবাই ধুনীর চারদিকে গোল হয়ে বসলাম। প্রথমে ওই তান্ত্রিক মা যার মাথায় বেশ বড়ো জটা তিনি মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করলেন। সবাই কেমন সমাহিত হয়ে বসে। শুধু তাকিয়ে আমি। চায়ের জন্য প্রাণটা অস্থির হয়ে উঠেছে। যে মন্ত্র বলছেন তা খানিক্ষন শুনে প্রথমে ঋকবেদের মনে হলেও পরে মনে হলো না বেদ মন্ত্র নয়। এসব জীবনে কখনো শুনিনি। মন্ত্র উচ্চারণের তীব্রতা বাড়তে লাগলো। ধপ করে জ্বলে উঠলো ধুনি। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওই মাতার দিকে আর একবার ধুনীর দিকে। ওই মাতা বলে উঠলেন অগ্নিদেব উপস্থিত হলেন। তোমরা প্রণাম করো। মন্ত্র শক্তি দিয়ে অনেক কিছু করা যায় কিন্তু আগুন জ্বালানো যায় বলে জানতাম না। দেখিনি কখনো। আগে যোগ বিভূতি শুনেছি পড়েছি। সেতো অন্যের মুখে ঝাল খাওয়া। নিজে তো কখনো সেভাবে দেখিনি।
সবাই প্রণাম করলেন। আমিও করলাম। সব চেয়ে বয়স কম যে মহিলার তিনি উঠে এলেন সবাই কে চা দেবার জন্য। দেখে মনে হলো ২০/২২ বছর বয়স। আর একজন মাতাও উঠলেন পাথরের পাত্র সহ থালা হাতে নিলেন। মনে হলো স্বয়ং মা কালী। নৃতত্ত্ব বিচারে আমাদের আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিশেষ করে সাঁওতাল পরিবারের মতো চেহারা কিন্তু মুখ সম্পূর্ণ অন্য রকম। গায়ের রং অসম্ভব কালো।
প্রথম সেই পানীয় দেওয়া হলো ওই বয়স্ক মাতা কে। বুঝলাম ইনি এখানে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত। তারপর যার সাথে আমি এসেছি তাকে। এর পর সবাইকে একে একে। আমাকেও দেওয়া হলো। শেষে মঠের অধ্যক্ষকে। চুমুক দিলাম। বহু দিন আগে একবার এক থাই পরিবারের বাড়িতে এমন একটি পানীয় বাঁশের কাপে খেয়েছিলাম। একদম সেরকম খেতে। চা পান হলো। ওরা সব ধুনীর চারদিকে বসে। ঠান্ডা টা আস্তে আস্তে বাড়ছে বেশ। ধুনীর আগুন আর তাপ বেশ ভালোই লাগছে। হাতের ঘড়িতে দেখলাম প্রায় ৭টা। দেখতে দেখতে সময় চলে যাচ্ছিলো। উঠলাম সিগারেট ধরাবার জন্য। ওই মহারাজকে ডাকলাম কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য। উনি উঠে এলেন। দুজনে দুটি সিগারেট ধরিয়ে একটু দূরে দাঁড়ালাম। ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম আচ্ছা মন্ত্র দিয়ে আগুন জ্বালানো কি ভাবে সম্ভব ? উনি বললেন হ্যাঁ সম্ভব। তুমি বুজরুকি ভাবছো তো। বললাম হ্যাঁ। আমাকে বললেন যেমন দেখাতে তুমি বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্য হয়ে গ্লিসারিন আর পটাসিয়াম পারমাঙ্গানেট দিয়ে। জামা প্যান্ট চাদর সব কিছু পরেও এই যোগীর কাছে নিজেকে কেমন নগ্ন মনে হলো। কেমন যেন সব খুলে নিলো গা থেকে এক এক করে। দাঁড়িয়ে রইলাম মাথা নিচু করে। হাতের সিগারেট হাতেই পুড়ে যাচ্ছে। তুলে টানতে ও পারলাম না।
মাথা তুলে সিগারেটে জোরে একটা টান দিয়ে অনেক টা ধোঁয়া ছেড়ে দিলেন। একটা মিষ্টি গন্ধে ভোরে গেলো জায়গা টা। ঠিক আগে একদিন যেমন অভিজ্ঞতা হয়েছে নদীর ঘাটে। বললেন কেমন করে হয় যিনি করলেন তিনিই বলবেন তোমাকে। চলো গিয়ে বসি।
ধুনীর কাছে ফিরে এসে আবার বসলাম। সন্ন্যাসী ওই জটা ধারী মা কে বললেন যোগিনী মাতা এ বাংলা থেকে এসেছে। এই জগৎ কে অভিজ্ঞতা করার ইচ্ছা। অতীন্দ্রিয় জগৎ কে জানবে বলে বেরিয়েছে। শুনলেন। ওনাকে জিজ্ঞেস করলেন ওনার সাথে আমার পরিচয় কি ভাবে। তারপর দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে রইলেন। কোনো পলক পড়লো না। যোগিনী মা-এর মুখে একটা মৃদু হাসি। সিগারেট পুড়তে পুড়তে কখন ছোট হয়ে ফিল্টারে আগুন ধরে গেছে বুঝিনি। আঙুলে গরমটা লাগতে সম্বিৎ ফিরে ছুড়ে দিলাম একটু দূরে। যোগিনী মা বিশুদ্ধ হিন্দিতে বললেন (হিন্দি উচ্চারণ আমাকে অবাক করেছিল। যেন হিন্দি সাহিত্যের কোনো অধ্যাপক) আমি মন্ত্র মানি কি না। আমার অতি বাজে হিন্দিতে বললাম হ্যাঁ। আমাকে বললেন তোমার যাকে দেবতা বলছো সেগুলি এক একটি শক্তি বা অবস্থা ও বলতে পারো। এরা কেউ সেই পরমেশ্বর নয়। এখন এই দেবতার রূপ দেখতে যেও না। তা সাধক যেভাবে তাকে চেয়েছে সে সেই ভাবে তাকে ধরা দিয়েছে। কিন্তু এই দেবতা হলো মন্ত্রের আধীন। বললাম ঠিক বুঝলাম না।
একটু থামলেন। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। বললেন একটা বৈদ্যুতিক তরঙ্গ যখন শব্দ তরঙ্গ হলো তারপর তুমি সেই শব্দ শুনে শব্দটাকে বুঝলে তোমার অনুভব দিয়ে। আচ্ছা যদি সেই শব্দ টিকে আবার ওই বৈদ্যুতিক তরঙ্গে পরিবর্তন রূপান্তর করি তাহলে তাকে দিয়ে তুমি অন্য কাজ করতে পারো। বললাম হ্যাঁ। এখন সেই রকমই মন্ত্র একটি বা কয়েকটি শব্দ। তুমি তাকে উচ্চারণ করছো। সৃষ্টি করছো নাদ। এখন সেটা যদি উচ্চ স্বরে করো বা মনে মনে। সঠিক আবেগ দিলেই তাতে ভাইব্রেশন বা অনুরণন হবে। তখনই সেই শক্তি জাগ্রত হবে।
এখন মানুষ এই মন্ত্রকে প্রথমে গুরু শক্তি দ্বারা প্রাপ্ত হয়। তারপর জপ দ্বারা নিজের আধীন করে। তাহলে কি দাঁড়ালো। দেবতা মন্ত্রের আধীন আর মন্ত্র মানুষের আধীন। আর এই ভাবেই মানুষ সেই শক্তি কে নিজের দিকে চালনা করে। এখন কি বুঝলে? বললাম হ্যাঁ। যদি এর পরেও অসুবিধা থাকে তাহলে তুমি জিজ্ঞেস করো। মাথা নাড়লাম। বললেন এভাবেই এখানে অগ্নি প্রজ্জ্বলন হলো। বললাম সবাই পারবে? বললেন হ্যাঁ সব মানুষের ভেতরেই একই ক্ষমতা দেওয়া আছে। গুরু শক্তি নিজের জপ এবং সর্বোপরি তার মনের শুদ্ধতা যত বাড়াতে পারবে সে ততই ভালো পারবে।
সোমসুন্দরজী আমাকে তোমার ব্যাপারে জানিয়েছেন। এতক্ষনে বুঝলাম যিনি আমায় নিয়ে ঘুরছেন তার নাম সোমসুন্দর। হয় নির্জনে বসে গুরু নির্দেশিত পথে সম্পূর্ণ সাধনায় লীন হয়ে যাও। নাহলে ঘুরে বেড়াও এই ভারতভূমি। তুমি কতটা বসে থাকতে পারবে জানিনা। তোমার গুরু যতই বলুক বাড়িতে বসে কর তোর হবে। তুমি কি সে শুনবে। তোমার গুরুও ঘুরে বেড়াতো তুমিও বেড়াবে। হাসলাম।
এর মধ্যে আরও দুজন মাতা এলেন। তারা বললেন ভোগ তৈরী হয়ে গেছে। এদেরও হিন্দিও অত্যন্ত পরিষ্কার। ওই যোগিনী মাতা বললেন তোমার পথ দক্ষিণ মার্গ। আজ এখানে যা দেখবে বাম মার্গ। শুধু দেখবে। কোনো অনুভূতি তৈরী করতে যেওনা। ভালো খারাপ কোনো ধারণা পোষণ করতে যেও না। কারণ এই মার্গের কিছুই তুমি বোঝোনা। শুধু দেখবে। আরও একটা কথা তোমার তো অভ্যাস যা দেখবে তাতেই প্রশ্ন করবে কেন? এখানে কেউ কেন এর উত্তর তোমায় দেবেনা।
বললাম তাহলে কি কোনদিন ও জানতে পারবো না? বললেন না তা নয়। আগে তোমার পথে এগোও। সময় এলে জানতে পারবে। সেই বোধের স্তরে যখন পৌঁছাবে বোঝার ক্ষমতা হবে তখন। কেমন যেন নিমপাতা খেলে মুখটা হয় সে রকম হলো। আমার মুখের ব্যাদন দেখে পরে আসা দুজন মাতা এমন কিছু বললো ওই যোগিনী মাতা কে সেটা এখানে লিখলাম না। শুধু লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলাম। এর পরের ঘটনা আর কিছুই লিখছি না। এর পরে শুধু একটি জায়গা থেকে লিখছি যার থেকে পরের পর্বে যেতে পারবো।
তখন রাত প্রায় ৩টা। মশালের আলো কমে এসেছে। ধুনীর আগুন ও কম তবে জ্বলছে। সেই পঞ্চমুন্ডীর আসনে বসে আছেন দুজন নারী-পুরুষ। নারী পুরুষের কোলে বসে আছেন। দুজনেই সম্পূর্ণ নগ্ন। হালকা আলোতে এক অদ্ভুত লাগছে। দুজনেই সম্পূর্ণ একে অপরের সাথে মিশে আছে। আস্তে আস্তে দুটো দেহ কেমন ট্রান্সপারেন্ট হতে লাগলো। গায়ের লোম গুলো সব খাড়া হয়ে উঠলো। দেখতে দেখতে দুজনেই মিলিয়ে গেলেন। সবাই এক ভাবে চেয়ে আছে ওই বেদির দিকে।
প্রায় আধঘন্টা কেটে গেলো। ধীরে ধীরে দুটো ট্রান্সপারেন্ট বডি দেখা গেলো ওই বেদির ওপরে। যেন কাঁচের মতো। আস্তে আস্তে তা সম্পূর্ণ রূপ পেলো। সবাই ওনাদের দূর থেকে প্রণাম করতে লাগলো। দেখা দেখি আমিও।
ঠিক তিনটে পঞ্চাশ ঘড়িতে। দেখলাম ধুনীর সামনে সবাই জড়ো হয়েছে। আরও কাঠ দেওয়া হয়েছে। সবাই সমস্বরে বেদ মন্ত্র পাঠ শুরু করেছে। পুরো পরিবেশ দেখে মনে হয়েছে যেন কোন প্রাচীন কালে চলে গেছি।
প্রায় ১ঘন্টা চললো। অন্ধকার তখনও আছে। অর্ক দেবের রেখার দেখা নেই। শঙ্খিনীর প্রভাবে শীত বোঝার ব্যাপার নেই। ঘুম ও নেই। যে যার মতো উঠে চলে গেলো। বুঝলাম কাছাকাছি কোনো ডেরা আছে সেখানে ওনারা থাকেন। ঝুপড়ি ওই মন্দিরে গিয়ে প্রণাম করলাম দেবী কে। সোমসুন্দরজী কে দেখলাম এক জায়গায় ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছেন। চোখ দুটি খোলা কিন্তু সে চোখে যেন কোনো দৃষ্টি নেই।
কাছে গিয়ে ডাকলাম মহারাজ। তাকালেন আমার দিকে বললাম কি করবো এখন। হাতের ইশারায় একটা সিগারেট চাইলেন। ওনাকে দিয়ে দুজনে ধরালাম। চুপচাপ একটু সময় কাটলো। বললেন কাল যে দেখলে যোগিনী মা আর নিত্যানন্দ দুজনে কেমন স্বচ্ছ হয়ে মিলিয়ে গেলো, খুব উৎসাহ নিয়ে বললাম হ্যাঁ। কাল নিত্যানন্দ পরমহংস হলো। যোগিনী মা অনেক উপরের স্তরের যোগী তান্ত্রিক। নিত্যানন্দ খুব অল্প বয়সে হলো। বহু জীবনের সুকৃতি। যোগিনী মায়ের কৃপা ও সাহচর্যে বাকিটা হলো। আসলে কি যেন, থামলেন একটু, কোথাও যেন একটু দুঃখ, আত্মজ্ঞান পেলে তারপর সাধকের আসল যাত্রা শুরু হয়। হ্যাঁ গুরু বলেছেন আমায়।
যোগিনী মায়ের আসল দীক্ষা দেহ অন্যত্র আছে। এটি ওনার নতুন দেহ। এই নিয়ে তিনবার দেহ পরিবর্তন হয়েছে। মাথায় কিছু ঢুকলো না। দীক্ষা দেহ কি মহারাজ? যে দেহ তে উনি সিদ্ধ হয়েছেন। তারপর দেহ পরিবর্তন কেন? হাসলেন, বললেন পরে বলবো। দুজনেই চুপচাপ। মাঝে মাঝে একটা দুটো কথা।
বললেন এখানে এখন অনেক দিন এরা থাকবেন। বললাম আমরা কি করবো? বললেন আজ আমরা যাবো। সিগারেট ফেলে বললেন এস আমার সঙ্গে উঠলাম। একটু এগিয়ে গিয়ে এক জায়গায় দেখলাম একটি ঝুপড়ি। বললেন এস। ঢুকলাম ভিতরে। একটু বিশ্রাম করে নাও। কম্বল পাতা আছে। ওখানে পাত্র তে জল রাখা আছে। নিয়ে স্নান করে নিতে পারো। দেখ ভালো লাগবে। স্নান যে করবো কি দিয়ে করবো? মগ তো নেই। কমণ্ডলু নিয়ে কর দেখো পাশে আছে। মহারাজ বললেন। হালকা প্রদীপের আলোয় দেখতে পেলাম। স্নান হলো। ফিরে এসে পাতা কম্বলে জয় মা বলে শুয়ে পড়লাম। স্নানটা করতে বেশ আরাম লাগলো। ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙলো মহারাজের ডাকে। দেখি বেশ বেলা হয়ে গেছে। ১১টা বাজে। উঠে পড়ে তৈরী হয়ে নিলাম। মহারাজ বেরিযে বাইরে গেলেন। আমি ও বেরিয়ে বাইরে এসে দেখলাম ধুনীর কাছে অল্প ক'এক জন বসে আছে। গেলাম ওখানে। বসে পড়লাম।
যোগিনী মা বললেন সোমসুন্দরজীকে, আমাকে শঙ্খিনীর পুরিয়াটা দিতে। মঠের অধ্যক্ষর থেকে চেয়ে নিয়ে আমাকে দিলেন। খুলে দেখলাম। কাল রাতে তো কিছু বুঝিনি। ভালো করে দেখি ঘুড়ির সুতোতে মাঞ্জা দেওয়ার সময় যেমন কাঁচ গুঁড়ো করা হয় তেমন বস্তু। অমনি দেখতে। তবে একদম মিহি নয়। সূক্ষ্মদানা। সোমসুন্দরজী আমাকে বললেন ঠান্ডা লাগলে একটি দানা জিভে দিও। একের বেশি নয় কোনো ভাবে।
যোগিনী মা সোমসুন্দরজী কে বললেন আমাকে কদলীবনম (Kadalivanam) নিয়ে যেতে। ওখানে অনেক উচ্ছকোটির মহাত্মা এসেছেন। দর্শন হবে আমার। প্রসঙ্গত বলে রাখি কদলীবনম (Kadalivanam) সাধারণ যাত্রীরা যেতে পারেন। তবে কখনোই একা বা নিজেরা যেতে যাবেন না। ওখানকার ট্যুর গাইড নিয়ে যাবেন। না হলে জঙ্গলে পথ হারাবেন। ওখানে অনেক সময় অনেক সাধু মহাত্মা নিরন্তর ধ্যান বা সাধন কাজে থাকেন।
পাত্রে খিচুড়ি র মতো এলো সঙ্গে বেগুনের একটা কষা মতো। সবাই খেলাম। এর মধ্যে কিছু কথা হলো। তারপর সবাই কে নমঃ নারায়ণ বলে এগিয়ে চললাম মহারাজের সাথে কদলীবনম এর দিকে। ঘড়িতে বাজে সাড়ে বারোটা।
আবার সেই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটা। খানিকটা রেখা ধরে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটু রাস্তাটা হয়েছে। বেশ ভালো লাগলো। বুঝলাম এইপথে লোক যাতায়াত করে। কিছু স্থানীয় আদিবাসী পুরুষ ও মহিলা মাথায় কাঠ নিয়ে যাচ্ছে। খানিকটা হাঁটার পরেই একটা দারুন জায়গা দেখতে পেলাম। মহারাজ বললেন এই হলো কদলীবনম (Kadalivanam), চলো এগোই।
পাহাড়ের একটি গুহা। মহারাজ বললেন এটাই আক্কামহাদেবী গুহা। এই কদলীবনম (Kadalivanam) এর কথা তুমি স্কন্দ পুরানে পাবে। তোমার গুরু পরম্পরার আক্কালকোট স্বামী এখানে বহু দিন তপস্যা করেছেন এবং সিদ্ধি লাভ করেছেন। ভগবান দত্তাত্রেয়ও এখানে এসেছেন সাধনার কাজে। খুব পুণ্য স্থান। দেখলাম সব ঘুরে ঘুরে। বললেন তুমি ধ্যানে বস। আমি আছি।
আসন পেতে বসলাম। বললেন এখানে এখনো সিদ্ধদের অনুভব পাবে। কারণ নিয়মিত বহু সিদ্ধ সাধক এখানে আসেন। সাধনা শেষ হলে উনি ওখানে থাকা কিছু সন্ন্যাসীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয় পর্ব শেষ হলে একজন বললেন আজ রাতে যজ্ঞ আছে আমাদের থাকতে। সোমসুন্দরজী খুব বিনয়ের সাথে বললেন আজ আমরা থাকতে পারবো না। প্রায় বেলা ৩টা। বললেন চলো একটু পা চালিয়ে। বেশ খানিকটা যেতে হবে।
আর সম্পূর্ণ জঙ্গলের রাস্তা। আলো থাকতে থাকতে পৌঁছাতে চাই। হিমালয়ের রাস্তার মতো না হলেও পাহাড়ী পথ, বেশ বাজে রাস্তা। তার মধ্যে জঙ্গল। ক্রমে পথ সরু হয়ে রেখা হয়ে গেলো। আমরা এগোচ্ছি। এবার যে কোথায় যাচ্ছি কিছুই জানি না। পাহাড় আর ঘন জঙ্গল। মহারাজ কে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাচ্ছি? বললেন আমার ডেরায়। সেটা কতদূর? বেশি নয় পা চালিয়ে চলো।
কি অদ্ভুত দ্রুততায় যাচ্ছেন উনি। আমি তো হোঁচট খাচ্ছি প্রতি পদে ওই গতির সঙ্গে তাল মেলাতে। এতো শক্তি আসে কথা থেকে কে জানে? তবে একটা জিনিস বুঝতে পারছি উঠছি ক্রমশ ওপরের দিকে। কারণ চলছি চড়াই ভেঙে। প্রায় ১ঘন্টা হেঁটে ফেলেছি। ঝট করে হাতের ঘড়িতে দেখে নিয়েছি। অন্ধকার হয়ে এসেছে কারণ জঙ্গল বেশ গভীর। সামনেও ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। বেশ কসরত করে চলতে হচ্ছে।
আচ্ছা মহারাজ ওখানে যাচ্ছি কেন? পরে বুঝবে। কি বুঝবো কে জানে। জানতে শুনতে দেখতে তো বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু এতো ধোঁয়াশা সব কিছুতে। আবার সব জিনিসের ব্যাখ্যা পাবো না।