top of page
Writer's pictureSadhguru

রহস্যময় শ্রীশৈলম - পর্ব ৬

Aবং হলো ১৯৮০ সাল থেকে তার সাধনার জীবনের নানা কাহিনীকে তুলে ধরা। পূর্ব জীবনকে জানার জন্য অবধূত নানা কাজের সূত্রেও সেই সব জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন সঙ্গে মিলিয়ে নিলেন নিজের জীবনের ছন্দকে।  অবধূতের জীবনের নানা ঘটনাকে তুলে ধরা হবে এই Aবং বিভাগে। তাঁর শ্রীশৈলম ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এখানে দেওয়া হলো পর্বে পর্বে। আজকে ষষ্ঠ পর্ব। 




উনি যেমন লিখেছেন সৌন্দর্য্য লহরী মা ত্রিপুরা সুন্দরীর জন্য। তেমনি পরাৎপর শিবের জন্য এই শিবানন্দ লহরী। শিখরে যেও শিখরেশ্বর আছেন। ওখান থেকে মোক্ষ -এর জন্য প্রার্থনা করো।

 

তুমি তো বহু জায়গায় ঘুরবে ঠিক করে বেরিয়েছ। বললাম হ্যাঁ মহারাজ। সাধনভজন করো। এমন মানুষ কে গুরু পেয়েছো যাকে সব বলবে আর বলবে করে দাও। নিজে করো। বেশ একটু কপট রাগ দেখালেন। আমরা যেন আছি তোমার ডেমোনেস্ট্রেটর। অনুভূতি হলেও বিশ্বাস হয় না। আবার খুঁতখুঁতুনি। প্র্যাক্টিক্যাল দেখবো। ভাগ্য করে জন্মেছ। দেহধারী কোন গুরু আসবেন সে কি মন্ত্র দেবেন তাও বলে দেয় তোমায়। কি আবদার। বৃদ্ধ সন্ন্যাসী অনর্গল বলে যেতে লাগলেন। দুপুরে খাবে কি? আমার যেন যত জ্বালা। কাল নবমী কাল অবধি থাকবে এখানে তারপর আমার সাথে যাবে এক জায়গায়। সুবোধ বালকের মতো মাথা নাড়লাম। মনে মনে সেই গুরুর গুরু পরম গুরু কে কৃতজ্ঞতা জানালাম। কারণ তার সাথে যে মারপিট ঝগড়া আদর আবদার মান অভিমান মায় কাতুকুতু অবধি চলে। কি করবো। আমি যে অমনি। উঠলাম ওখান থেকে মল্লিকার্জুন সদনের পথে। একটা ছোট্ট পোস্তর দানার মতো জিনিস দিলেন বললেন জিভের ডগায় ঠেকিয়ে ফেলে দাও। তারপর এগিয়ে যাও। যা বললেন করলাম। থু করে ফেলে দেবার পর শরীর দিয়ে আগুন ছুটতে লাগলো। কি শক্তি তখন শরীরে। বললাম কি এটা। শঙ্খিনী? না যাও এখন।

 

নমঃ নারায়ণ বলে উঠে পড়লাম। খুব দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠলাম। ভাবছি কি ঘটলো এতোক্ষণ। শুধু কি আমার কৌতহল নিবৃত্তির জন্য এই সন্ন্যাসীর এতো কিছু না কি অন্য কিছু আছে এর পেছনে। শহুরে মানুষের সন্দিগ্ধ মন। কিছু মানে তো অনেক কিছুই মানে না। সব কিছুতে অঙ্ক মেলাতে চাই। অবধূত বলেন এই জগৎ কে বুঝতে শিশুর সারল্য লাগে। কিন্তু সে ক্ষমতা আমার কৈ?

 

এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম মল্লিকার্জুনসদন এর আমার ঘরে। চাবি খুলে ভিতরে ঢুকলাম।

 

একটু বসলাম। কোনো ক্লান্তি নেই। এক তীব্র উত্তেজনা। ঠান্ডার কোনো অনুভব ও নেই। ঠান্ডা জলে ভালো করে স্নান করলাম। খিদে তৃষ্ণা কিছুই নেই। জামাপ্যান্ট পরে তৈরি হলাম কাছাকাছি জায়গা গুলো দেখার জন্য।

 

নিচে নেমে জীপস্ট্যান্ড যাবো। কি মনে হোল হেঁটেই যাবো ঠিক করলাম। যেহেতু একটাই রাস্তা পথ হারাবার ভয় নেই। সদনের মূল দরজা দিয়ে বেরিয়ে ডান দিকে জীপ্ স্ট্যান্ডের দিকে না গিয়ে বামদিকে হাঁটা লাগলাম। হালকা উৎরাই খুব দ্রুত নামতে লাগলাম। দুদিকের প্রকৃতি খুব সুন্দর। মন ভোরে যায়। চারদিকে দেখছি। মসৃন পিচঢালা রাস্তা। এমনিতে অন্ধ্রপ্রদেশের প্রায় সব জায়গায় রাস্তাঘাট খুব ভালো এবং খুব সুন্দর করে মেইনটেইন করা হয়। বেশ খানিকটা নেমে দেখলাম হোর্ডিং লেখা Shikharam, বুঝলাম এই সেই শিখরেশ্বরের মন্দির। বেশ কিছু বাঁদর ও হনুমান রাস্তায় নামছে আবার উঠে যাচ্ছে। আমার নামার সময় বামদিকের পাহাড়ের সিঁড়ি পেলাম ওপর ওঠার জন্য। বেশ ফাঁকা। নিচে কিছু মানুষ সব তীর্থক্ষেত্রে যেমন ফুল বেলপাতা ইত্যাদি নিয়ে বসেন এখানেও তাই। একদমই স্থানীয় মানুষ জন। দুএকজন নানা রকম পাথর শিবলিঙ্গ মৃগনাভি ইত্যাদি নিয়ে বসে আছেন। ফুল আকন্দ ফুলের মালা, বেলপাতা আর মুড়ি মিশ্রী নিয়ে ওপরে উঠলাম মন্দিরে যাবার জন্য। দেখলে বুঝতে পারবেন প্রাচীনত্ব আর নেই। আধুনিক tiles আর ম্যুরালে চারদিক সাজানো।

 

শিখরম স্কন্দপুরাণে বলা আছে শ্রীশৈলের শিখর যিনি দেখেছেন তাঁর জন্ম মৃত্যর কালচক্র থেকে মুক্তি হয়ে যাবে। বলাহয় যাঁরা গোপুরম দেখতে পাবেন তাদের আর পুনর্জন্ম হবে না।

 

"শ্রীশৈল শিখরম দ্রষ্টবা, পুনর জন্মম ন বিদ্যতে।"

 

এই বিশ্বাস নিয়ে ই মানুষ এখানে আসেন।

 

ওপরে উঠে দেখলাম তিনটি শিব মন্দির। মাঝেরটি মূল মন্দির। তখন অভিষেক প্রায় শেষের পথে। একটু অপেক্ষা করলাম। অভিষেক শেষ হতে পূজারীর হাতে ফুল ইত্যাদি তুলে দিলাম। উনি পুজো করালেন। একদম ফাঁকা মন্দির আমি একা। দক্ষিনা দিয়ে ওনাকে হিন্দিতে বললাম এই মন্দিরের কথা যদি কিছু বলেন। অত্যন্ত ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে যা বললেন তার মর্মার্থ এইরকম। প্রায় ২৮৩০ফুট উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে। শ্রীশৈল পর্বত গুলির মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ উচ্চতার। এখানে মন্দিরে যিনি শিবলিঙ্গ আছেনা তাঁর নাম শ্রী বীর শিখর স্বামী (তেলেগু ভাষার উচ্চারণ করলে Sri Veera Shikhara Swamy) যাঁকে স্থানীয়রা বলেন শিখরেশ্বর স্বামী। এই মন্দির তৈরী হয় ১৩৯৮খ্রিস্টাব্দে এখানকার তৎকালীন রেড্ডি রাজাদের দ্বারা।

 

মধ্যযুগে এই স্থান ছিল শৈব এবং তান্ত্রিকদের গুপ্ত সাধন ক্ষেত্র। এবং শৈব পরম্পরার বহু ক্রিয়া এখানে স্বাধিত হতো. তারপর বললেন এখনো নানা জায়গা থেকে শৈব এবং অঘোরীরা এখানে আসেন তাদের নানা গুপ্ত ক্রিয়ার জন্য।

 

উনি বললেন চলো উপরে নিয়ে যাই তোমায়। উপরে গিয়ে দেখলাম একটা গম্বুজের মতো জায়গায় এক নন্দী মূর্তি। চারদিকে পাহাড় আর ঘন জঙ্গল। বললেন দেখ গোপূরণ দেখতে পাছো। বললাম কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। বললো ওই তো দেখা যাচ্ছে। আমি কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। এবার বললো চলো তোমায় মন্ত্র পাঠ করাই। নিয়ে গেলেন। বাম হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে নন্দী মূর্তির শিং ধরতে বললেন, আর ডান হাত দিয়ে লেজ। এবার বললেন মূর্তির কানে বোলো কিছু বললেন যার আগা মাথা কিছুই বুঝলাম না। বললেন ১০টাকা দাও। দিলাম। এবার তোমার মনস্কামনা জানাও। একই ভাবে নন্দীর কানে মনস্কামনা জানিয়ে চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম।

 

সাধারণত এসব জায়গায় এলে বেশ খানিকক্ষণ ধ্যানে বসি আজ যেন কিছুই ইচ্ছা করলো না। এদিক ওদিক একটু ঘুরে পুরো জায়গাটা ভালো করেদেখে নেমে এলাম।

 

এগোলাম ফলধারা-পঞ্চধারার দিকে। এটা আরও নিচের দিকে নামতে হবে। ওখানে অনেক মন্দির আছে। আদি শঙ্করের অনেক সাধনক্ষেত্রের এক সাধন ক্ষেত্র ভাবলেই কেমন যেন হয়। আদি শঙ্করাচার্য সনাতন ধর্ম কে আবার জাগিয়ে তুলেছিলেন। অনেক মিথ। কতোবছরের জীবন ৩৪ না ৮৫? না কি আরও বেশি। সৌন্দর্য্য লহরী মতো লেখা। কি বর্ণনা। কে তাঁর গুরু ? গুরু গোবিন্দ পাদ না কি গুরু গৌড়পাদ?

 

গুরু গৌড়পাদ যিনি লিখেছেন মাণ্ডুক্য কারিকা। আমার বাংলার ই মানুষ ছিলেন। শ্রীবিদ্যার দীক্ষা দিলেন সুদূর কেরালা থেকে আসা এক শিষ্যকে। কেন দক্ষিণ ভারত ঘুরে, হিমালয় ঘুরে আদি শঙ্কর গেলেন নর্মদায়? এসব ভাবতে ভাবতে দ্রুত নামছি।

 

এতটা হাঁটলাম কোনো ক্লান্তি নেই ক্ষিদে ও নেই তেষ্টাও নেই। পৌছালাম সেই আদি শঙ্করাচার্য্যর মূর্তির কাছে। মূর্তিটি আমার বাম দিকে। এই জায়গাটি খুব সুন্দর। অনেকক্ষন ধরে ধ্যান করার জন্য আদর্শ। তবে বেলা বাড়লে লোকজন বাড়ে। এখানকার পৌরাণিক কথা হলো ভগৰান শিব এখানে এক মৃৎশিল্পীর কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন। ওখানকার স্থানীয় ভাষায় মাটির পাত্রকে বলে "আটিকা" সেই থেকে হয় আটিকেশ্বরম। পরে অপভ্রংশ হয়ে এই স্থান পরিচিত হয় হটকেশ্বরম বলে।

 

এখানে যে শিবলিঙ্গ আছে তাকে এরা হটকেশ্বর বলে। পাথরের মন্দির একাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে বানানো। এই মন্দির দর্শন করতে গেলে যেতে হবে আদি শঙ্করাচার্য্য র মূর্তির ঠিক উল্টোদিকে রাস্তায়। একটু পাহাড়ের ওপরে। হেঁটেই ওঠা যায় খুব উঁচু নয়।

 

দেখে এলাম মন্দির। প্রণাম করলাম। একটা ছোট মন্দির পেলাম রাজরাজেস্বরীর মন্দির। ভিতরে একটি শ্রী যন্ত্রম বসান আছে ললিতা ত্রিপুরসুন্দরীর একটি অনেক পুরোনো পাথরের মূর্তি ও আছে। বসলাম ওখানে একটু সময় মন্ত্র জপ করলাম। বেশ ভালো লাগলো। একটা অন্য অনুভূতি পেলাম। উঠে এলাম ফলধারা দেখবো বলে বলে।

 

আদি শঙ্করাচার্যের মূর্তির পাশ দিয়ে চওড়া সিঁড়ি নেমেছে। শুনলাম অনেক টা নিচে নামতে হবে। দুপাশে অল্প কিছু মানুষ বসে আছেন ডালা নিয়ে। কিছু নিলাম না। নিচে নামতে লাগলাম। সিঁড়ি আবার একটু সরু হয়ে গেলো। তবে নামা ওঠার কোনো সমস্যা নেই। নিচে নেমে দেখলাম একই বড়ো পুরোনো গাছ। তার তলায় ছোট্ট মন্দির। ওখানে বসে ই সেই মহান গুরু আদি শঙ্করাচার্য তপস্যা করেছিলেন বহু দিন।

 

গুরু বলেছিলেন ওখানে আগে যাতায়াতের এমন ব্যবস্থা ছিল না। আদি শঙ্কর আকাশমার্গে গেছিলেন। প্রচুর বাঘ আছে নিচের পাহাড়ে আর জঙ্গলে। আগে এখানেও ছিল। এখন রিজার্ভ ফরেস্ট হওয়ায় নেই ওখানে। দেখলাম সেই স্থান। আদি শঙ্করের মূর্তি। বসলাম। প্রণাম করে প্রার্থনা জানালাম। পাশে ই দেখলাম দুটি জলের ধারা নেমে আসছে একটি পাহাড়ের মাঝখান থেকে। ওখানকার যিনি পুরোহিত বললেন ফলধারা পঞ্চধারা এটিই। দুটি আলাদা জায়গা থেকে জলটি আসছে। মনে পড়লো স্কন্দপুরাণে বলা হয়েছে ভগবতী এখান থেকে গিয়ে কৃষ্ণাতে মিশছে।

 

এখানকার লোকেদের মতে এই জলের ধারা শিবের কপাল থেকে নির্গত হচ্ছে। ফল মানে কপাল আর ধারা অর্থাৎ জলের প্রবাহ। আর পঞ্চধারা হলো পাঁচতত্ত্বের ধারা। পুরোহিত বললো সারাবছর এই ধারা একই ভাবে থাকে।

 

চারদিকটা ঘুরে দেখলাম। অপূর্ব জায়গা। সত্যি তপস্যা করার জায়গাই বটে। শান্ত। কোনো কোলাহল নেই। জলের ধারার আওয়াজ আছে। মাঝে মাঝে পাখির ডাক।

 

এখানে বসেই আদি শঙ্করাচার্য লিখেছেন শিবানন্দলহরী। কতবছর যে সাধনা করেছেন মা ললিতাঅম্বিকার জন্য কে জানে। এই দুর্গম জায়গা। তখন তো কিছুই ছিল না এখানে। আদি শঙ্করাচার্য্যর কথা মনে হলেই আমার শুধু মনে হয় কবে দেখতে যাবো সেই রহস্যময় জায়গা ওমকারেশ্বরের কাছে। যা মহাত্মা প্রলয়দাসজী দেখিয়েছিলেন শৈলেন্দ্র নারায়ণ ঘোষাল কে।

 

পুরোহিত কে জিজ্ঞেস করলাম এখানে একটু ধ্যানে বসতে পারি? বললো মন্দিরে উল্টো দিকে বসো কোনো অসুবিধা হবে না। ১০টা অবধি খুব কেউ আসে না।

 

আসনটা পেতে বসলাম। গুরু আবাহন করে গুরু প্রদত্ত মন্ত্র জপ শুরু করলাম। খুব সামান্য সময় মনে হলো। এক গভীর ধ্যানে চলে গেলাম। কোনো শব্দ কোনো কিছুই কানে ঢুকছেনা।

 

মনে হচ্ছে মাথার ওপর যেন একটা ভারী কলাম কেউ বসিয়ে দিয়েছে। অসম্ভব চাপ। একটু পরেই অনুভব করলাম সাহস্রার থেকে মূলাধার এক শক্তির প্রবাহ নেমে আসছে ক্রমাগত।

 

ক্রমে বাড়ছে এই শক্তির প্রবাহ। কি তীব্র সেই শক্তি। শরীরের প্রতিটি কোষ যেন নৃত্য করছে সেই শক্তির অনুরণনে। শরীরের ভিতরের থেকে ক্রমাগত শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কখনো ঝিঁঝির ডাক তো কখনো সমুদ্রের গর্জন। একসময় সব যেন শান্ত হয়ে গেলো। এক চরম তৃপ্তি। এই ভাবে বেশ খানিকক্ষণ বসে রইলাম। শান্তি।

 

ধীরে ধীরে চোখ খুললাম। দেখি পূজারীজী আমার সামনে হাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে। কি ঘটলোরে বাবা। এ আবার আমার সামনে হাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে কেন? আমায় উঠতে দেখে উনি বসলেন। হাত জড়ো করেই আছেন। কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমিও প্রতি নমস্কার করে নমঃ নারায়ণ বললাম।

 

ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলেন আমার দীক্ষা কি? গুরু পরম্পরা কি ? বললাম। মুখে এক বিস্ময় নিয়ে বললো সার্থক আমার গুরু পাওয়া। আগা মাথা কিছু বুঝলাম না উঠে পড়লাম। কোনো প্রশ্ন ও করলাম না। কারণ যে অনুভূতি পেয়েছি তখন তাতেই বুঁদ হয়ে থাকতে চাই। প্রশ্ন উত্তরের কচকচি ভালো লাগছিলো না।  

 

আবার ওই ছোট্ট মন্দিরের সামনে গিয়ে প্রণাম করে এগোলাম। দেখলাম পূজারীও পিছনে এলেন। কিছু মনে হয় বলতে চায়। কিন্তু আমার কিছু ভালো লাগছিলো না। তাই কিছু আর ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম না।

 

সাক্ষী গণপতি মন্দিরে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল গণপতি কে সাক্ষী রাখতে। সেও গেলাম না। পরে যাবো তখন গিয়ে বলবো ঠিক করলাম। ফিরে চললাম গেস্টহাউসের দিকে। আমি যেন ওই নাদ ও কম্পনের অনুভূতিতে ই ডুবে আছি।

 

কখন যে মল্লিকার্জুন সদনের সামনে পৌঁছে গেছি হাঁটতে হাঁটতে বুঝতেই পারিনি। প্রায় ২২কিমি হাঁটলাম কোনো ক্লান্তি নেই তেষ্টা নেই খিদে নেই। সন্ন্যাসী কি দিলেন জীবের ডগায় শঙ্খিনী তো নয় বললেন। তবে কি সেই মাকড়সার বিষ? যা কালিকানন্দ অবধূত লিখেছিলেন। যাকগে। এখন গিয়ে একটু শুয়ে পড়ি। ও তার আগে স্নান করতে হবে।

 

রুমে ঢুকলাম। স্নান করলাম ভালো করে। শুয়ে পড়লাম। কেমন যেন অস্থিরতা। খুব রাগ হলো সন্ন্যাসীর ওপর। কেন যে আমায় দিলো এসব। দিব্যি শান্ত অবস্থা। খাচ্ছিদাচ্ছি সাধনা করছি ঘুরছি ঘুমাচ্ছি। তা না কি উৎপাত।

কিছুতেই শুতে পারলাম না। ঘুমানো তো দূরের কথা। শুলেই কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। ধুর বলে উঠে পড়লাম। একটা সিগারেটে ধরিয়ে বসলাম জানালার সামনে। যা যা ঘটলো সংক্ষেপে লিখে ফেললাম নিজের নোটবুকে। মায় সন্ন্যাসীর দেওয়া ওই পোস্তর দানার মতো পদার্থের কথাও।

 

মনে করতে লাগলাম গুরুর সেখান পদ্ধতি কে। কি ভাবে এই জ্যোতির্লিঙ্গের অসীম শক্তিকে untapped করবো। ভাবছিলাম ভ্রামরী মায়ের কথা।

 

शिवपार्श्वस्थिता मता श्रीशैले शुभापिताके।

भ्रमराम्बा महादेवि करुनारसावीक्षणा ।।

 

দেবীর এখানে গ্রীবা পড়েছিল বলা হয়। এখন পৌরাণিক কাহিনী হলো ব্রহ্মার বরে অরুনাসুর ছিল প্রায় অমর। অরুনাসুর গায়ত্রী মন্ত্র বহুদিন জপ করে ব্রহ্মাকে তুষ্ট করে অমরত্বের বর চায়। ব্রহ্মা অমরত্বের বর দিতে অক্ষম বলে এই বর দেয় অরুনাসুর কে কোনো দ্বিপদ এবং চতুর্পদ প্রাণী দ্বারা বধ হবে না। । দেবরাজ ইন্দ্রর তো সব সময় ভয় এই বোধ হয় গেলো তার স্বর্গ। কারণ সে দেবী রতির কাছে এই অভিশাপই পেয়েছিলো। সব সময় স্বর্গ রাজ্য হারাবার ভয় নিয়ে তাকে চলতে হবে। তাই সে দেব গুরু বৃহস্পতির সাথে পরামর্শ করলো কিভাবে অরুনাসুরকে বধ করা যায়। দেবতারা তখন আদি শক্তির উপাসনা করতে লাগলো। আদি শক্তি জানালেন অরুনাসুর নিরন্তর তার সাধনা করেন। তিনি যতক্ষণ না তাঁর সাধনা বন্ধ করছেন ততক্ষন তিনি দেবতাদের দ্বারা অবধ্য। দেবগুরু বৃহস্পতি ইন্দ্রর বুদ্ধিতে অরুনাসুর কে ভুলিয়ে এই সাধনা বন্ধ করেন। তখন দেবী রুষ্ট হয়ে ভ্রমর যার ছয় পা সেই রূপে আসেন। এবং লক্ষ লক্ষ ভ্রমরের আক্রমণে মৃত্যু হয় অরুনাসুরের। এর মধ্যে আরও অনেক গল্প আছে এত বিস্তারিত আর এখানে বললাম না।

 

আদি শঙ্কর লিখিত অষ্টাদশ শক্তিপীঠ স্তোত্রম এ মহাশক্তিপীঠ বলে উল্লেখিত ১৮ শক্তিপীঠের এটি একটি।

 

॥ অষ্টাদশশক্তিপীঠস্তোত্রম্ ॥ (মহাপীঠ নির্ণয়)

লঙ্কায়াং শাঙ্করী দেবী কামাক্ষী কাঞ্চিকাপুরে ।

প্রদ্যুম্নে শৃঙ্খলাদেবী চামুণ্ডী ক্রৌঞ্চপট্টণে ॥

অলম্পুরে জোগুলাম্বা শ্রীশৈলে ভ্রমরাম্বিকা ।

কোল্হাপুরে মহালক্ষ্মী মাহূর্যে একবীরিকা ॥

উজ্জয়িন্যাং মহাকালী পীঠিক্যাং পুরুহূতিকা ।

ওঢ্যায়াং গিরিজাদেবী মাণিক্যা দক্ষবাটকে ॥

হরিক্ষেত্রে কামরূপা প্রয়াগে মাধবেশ্বরী ।

জ্বালায়াং বৈষ্ণবী দেবী গয়া মাঙ্গল্যগৌরিকা ॥

বারণস্যাং বিশালাক্ষী কাশ্মীরেষু সরস্বতী ।

অষ্টাদশ সুপীঠানি য়োগিনামপি দুর্লভম্ ॥

সায়ঙ্কালে পঠেন্নিত্যং সর্বশত্রুবিনাশনম্ ।

সর্বরোগহরং দিব্যং সর্বসম্পত্করং শুভম্ ॥

ইতি অষ্টাদশশক্তিপীঠস্তুতিঃ ।


আদি শঙ্করের মতে এই ১৮টি হলো অষ্টাদশ শক্তিপীঠ

১ ত্রিনকোমালী (শ্রীলঙ্কা) কুঁচকি শঙ্করী দেবী

২ কাঞ্চীপুরম (তামিলনাড়ু) পৃষ্ঠদেশের অংশ কামাক্ষী দেবী

৩ প্রদ্যুম্না (পশ্চিমবঙ্গ) উদরের অংম শ্রুখলা দেবী

৪ মহীশূর (কর্ণাটক) চুল চামুণ্ডেশ্বরী দেবী

৫ আলমপুর (অন্ধ্রপ্রদেশ) উপরের দাঁত জগুলম্বা দেবী

৬ শ্রীশৈলম (অন্ধ্রপ্রদেশ) গ্রীবার অংম ব্রমারম্ভা দেবী

৭ কোলহাপুর (মহারাষ্ট্র) চক্ষু মহালক্ষ্মী দেবী

৮ নান্দেড় (মহারাষ্ট্র) দক্ষিণ হস্ত একাবীরিকা দেবী

৯ উজ্জয়িন (মধ্যপ্রদেশ) উপরের ওষ্ঠ মহাকালী দেবী

১০ পীঠপুরম (অন্ধ্রপ্রদেশ) বাম হস্ত পুরুহুটিকা দেবী

১১ জাজপুর (ওড়িশা) নাভি বীরজা/গিরিজা দেবী

১২ দ্রাক্ষরমন (অন্ধ্রপ্রদেশ) বাম গাল মণিকম্ব দেবী

১৩ গৌহাটি (আসাম) যোনিদ্বার কামরূপা দেবী

১৪ প্রয়াগ (উত্তর প্রদেশ) হাতের অঙ্গুলি মাধবেশ্বরী দেবী

১৫ কাঙ্গরা (হিমাচল প্রদেশ) মাথার অংশ বৈষ্ণবী দেবী

১৬ গয়া (বিহার) স্তনের অংশ সর্বমঙ্গলা দেবী

১৭ বারাণসী (উত্তর প্রদেশ) কব্জি/মণিবন্ধ বিশালাক্ষী দেবী

১৮ কাশ্মীর দক্ষিণ হস্ত সরস্বতী দেবী

 

উঠে পড়লাম। ভাবলাম একটু নদীর ধার থেকে ঘুরে আসি। কৃষ্ণা নদীর তীর শ্রীবিদ্যা সাধনার উৎকৃষ্ট জায়গা। অবধূত বলে দিয়েছেন। একটু সাধনা করি। সন্ধ্যায় যাবো মন্দিরে সন্ন্যাসী যেমন বলেছেন। কিছুই যেন করার নেই। না পারছি ঘুমাতে না লাগছে ক্লান্তি। না পাচ্ছে খিদে। রুটিনের থেকে কেমন যেন সব আলাদা। সে যে কি বিচ্ছিরি অভিজ্ঞতা কি বলবো।

 

ঘর বন্ধ করে নিচে নামলাম। হাটতে শুরু করলাম নদীর দিকে। ভাবলাম একটু রোপওয়ে চড়ি। ৫০টাকা টিকিট যাতায়াত মিলে। মাত্র ৫মিনিটের ট্যুর। যে জায়গাটিতে নামানো হয় তাকে পাতাল গঙ্গা বলে। বেশ খানিকটা হেটে গিয়ে রোপওয়ে কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে রোপওয়েতে চড়তে হবে। গিয়ে টিকিট কেটে একটু অপেক্ষা করতে হলো। ৪জন হলো আমার কেবিনে। ছাড়লো রোপওয়ে। বেশ সুন্দর ট্যুরটা। মিস না করে ভালোই করেছি মনে হলো। ওপরে উঠে এলাম।


করার তো কিছু নেই। তাই চারদিক একটু ঘুরে নিলাম। আবার এলাম ওই ঘাটের কাছে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলাম। নদীর ধারে পৌঁছে ঘাটের কাছে যেখানে সন্ন্যাসীর দেখা পেয়েছিলাম ওখানে গিয়ে বসলাম। শুরু হলো গুরু নির্দেশিত পথে সাধনা। স্থান মাহাত্ম্য এমন খুব দ্রুতই মনে হলো কান বন্ধ হলো। শুরু হয়ে গেলো নাদ। কখনো ঝিঁঝির ডাক তো কখনো সমুদ্রের গর্জন।


কতক্ষন কাটিয়েছি ওভাবে জানিনা। যখন ধ্যান অবস্থা থেকে বেরোলাম সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়। সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে আছেন পাশে। জিজ্ঞেস করলেন কেমন লাগলো। বললাম ভালো। বলেই বললাম কি দিলেন তখন বলুনত। খিদে নেই ঘুম নেই তেষ্টা নেই। ক্লান্তি নেই। সব যেন কেমন ছন্ন ছাড়া হয়ে গেলো। হো হো করে হেসে উঠে বললেন তা ছন্নছাড়া বৈরাগীর দরবারে এসেছো গৃহী থাকার জন্য কি এসেছিলে!


তীব্র প্রতিবাদ করলাম। শিব বৈরাগী নয়। তাকে জোর করে বৈরাগী বানানো হয়েছিল। সেকথা তুমি জানো না। আমার কাছে শিব বৈরাগী বলতে আসবে না।  শিবই যোগ তাই তিনি যোগ স্বরূপা, তিনিই তন্ত্র। আমি বাপু তোমাদের ওই বিষ্ণু নিয়ে আদিখ্যেতা করার লোক নয়। আমি শুধু সত্য বুঝি।  নাথ পরম্পরার লোক। তাই বৈরাগী শিবকে দেখতে আসিনি। শিব রাজরাজেশ্বর। জ্যোর্তিলিঙ্গতে তাহলে রাজবেশ পরাও কেন?


আসার আগে তো তাকে সব ভাবে অনুভব করতে চেয়েছিলে। দেখ কেমন লাগে ছন্নছড়া জীবন। এইটুকুতেই শখ মিটে গেলো? আর বই পড়া বিদ্যায় তো খুব শখ হয়েছিল শঙ্খিনী কি জানবার। সাধুরা হিমালয় কি ভাবে থাকে। ওদের ঠান্ডা লাগে না কেন? কি করে ওদের গ্লেসিয়ার টেস্ট হয়। এখন দেখ কেমন মজা।


রেগে বললাম শিবকে বৈরাগী দেখতে আসিনি।  আমাদের ওখানে তো অনেক দুখ্চেটে বৈরাগী দেখেছি তার জন্য এতদূর আসার দরকার কি? শঙ্খিনী, গ্লেসিয়ার টেস্ট এগুলো কি বলতো শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকে কিভাবে প্রভাবিত করে তা জানতে বুঝতে বেরিয়েছি। 


একটা নিস্তব্ধতা। বললেন যাও তৈরী হয়ে এসো। মন্দিরে যাবার সময় হয়েছে। উঠে পড়লাম। আবার সিঁড়ি ভাঙতে হবে। উঠে চায়ের দোকানে বসলাম। ইচ্ছা না থাকলেও চা বললাম। একটা সিগারেটে ও ধরালাম। দোকানি চা দিল। একটু করে চা খাচ্ছি আর সিগারেটে টান দিচ্ছি। আসলে আমি এই অবস্থা থেকে বেরোতে চাইছি। পারলাম না। বাকি চা ফেলে দিলাম। পয়সা দিয়ে উঠে পড়লাম গেস্ট হাউসের দিকে।

 

রুমে পৌঁছে জামা কাপড় চেঞ্জ করলাম। ধুতি পরে সামান্য কিছু টাকা ধুতির খুঁটে বেঁধে গায়ে একটা চাদর দিলাম। সঙ্গের মোবাইল টা ও রেখে দিলাম। চাবি দিয়ে চললাম মন্দিরের পথে।

 

আজ আমি খলিফা। কারন আমি খালি পায়ে এসেছি। জুতো পরে আসিনি। গেস্ট হাউসেই সে আপদকে রেখে দিয়েছি। তাই আজ আর এখানে জুতো ছাড়ার গল্প নেই। মন্দির একটু ফাঁকাই। খুব ভিড় নেই। গতকাল যারা এসেছেন সবাই প্রায় আজ দুপুরে পুজো দিয়ে চলে গেছেন। ধীরে ধীরে মন্দিরে ঢুকলাম। আজ কোনো সমস্যা হলো না। ঢুকে আগে মল্লিকার্জুন স্বামীর কাছে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলাম। উঠে বেরিয়ে গেলাম ভ্রমরাম্বিকা মন্দিরের দিকে। আজ মায়ের মন্দির একদমই ফাঁকা। চুপ করে বসে রইলাম। সাধনার ইচ্ছাও হলো না। ভ্রমরের শব্দ আজ খুব পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। হয়তো ফাঁকা বলেই বেশি স্পষ্ট সে আওয়াজ।

 

সন্ন্যাসী এলেন আমার সামনে। বললেন চলো আজ রাজরাজেশ্বরী মন্দিরের সামনে বসবে। ওখানেই করবে গুরু নির্দেশিত পথে সাধনা। উঠলাম। চললাম ওনার পিছু পিছু। লাইন দিয়ে যে ছোট ছোট মন্দির সেখানেই একটি ছোট মন্দির রাজরাজেশ্বরী মন্দির। মা ত্রিপুরসুন্দরীর মূর্তি। ওখানে বসতে বললেন। গায়ের চাদর টা ভাঁজ করে আসন বানিয়ে বসলাম।

 

চোখে মুখে জলের ছিটাতে তাকালাম। দেখলাম শুয়ে আছি সেই মন্দিরের সামনে। সন্ন্যাসীর মুখ আমার মুখের সামনে। বললেন ঠিক আছো, উঠতে পারবে? হাতটা ধরে ধীরে ধীরে ওঠালেন। উঠে বসে দেখলাম খুব খিদে পেয়েছে। গলাও শুকিয়ে গেছে। উঠে দাঁড়িয়ে ওনাকে ধরেই এগোলাম। আস্তে আস্তে বাইরে এলাম। বললেন যাও ভাণ্ডারাতে খেয়ে নাও।

 

প্রসাদের কাউন্টারের পাশে কল আছে খাবার জলের। ভালো করে চোখে মুখে জল দিলাম আর আঁজলা করে জল খেলাম। একটু হেঁটে ঢুকলাম খাবার জায়গায়। খেয়ে বেরিয়ে আসার আগে পাশের মানুষটি জিজ্ঞেস করলাম টাইম কত। বললেন সাড়ে দশটা।

 

বাইরে এসে যে রাস্তা মোবাইল কাউন্টারের দিকে গেছে সেদিকে একটু হেঁটে যেতেই দেখি সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে বললেন এখন যাও তোমার থাকার জায়গায়। চলো আমিও তোমার সাথে এগোচ্ছি। কাল সকালে এখানথেকে বেরিয়ে আগে যাবে সাক্ষী গণপতি মন্দিরে। পুজো দিয়ে গণপতি কে সাক্ষী করে আসবে যে তুমি ভোলে ভাণ্ডারীর দর্শনে এসেছিলে। সে তো এতো মনে রাখতে পারে না। তাই এই ব্যবস্থা। তারপর ফিরে এসে স্নান খাওয়া করে তৈরী থেকো। আমার সাথে যাবে।

 

যা দিয়েছিলাম তোমায় সেটির গুণ দেখলে তো। তোমায় সারাদিনের জন্য খিদে তৃষ্ণা সব মিটিয়ে দিলো। এটি একটা ফুলের রেনু। এর ক্ষমতা ১২ থেকে ১৪ঘন্টা। এমন আরও অনেক আছে যেগুলো একদিন পর্যন্ত। এগুলো এখানে পাওয়া যায়। তবে হিমালয় আছে আর নানা জিনিস। তার মধ্যে যেটি সর্বোচ্চ তার ক্ষমতা ১৮মাস। চোখ বোধ হয় আমার বেরিয়ে আস্ত তখন। সেটাও একটা ফুলের রেনু। ওই ফুল কেবল মধ্য হিমালয়ে পাওয়া যায়। আর সবাই চেনেও না তা। খুব উচ্চ কোটির যোগীরা তা চেনেন। কাল তোমায় শঙ্খিনী চেনাব। কাল আমরা কোথায় যাবো? জিজ্ঞেস করলাম। বললেন তখনই জানতে পারবে। এখন যাও বিশ্রাম করে নাও। ফিরে চললাম গেস্ট হাউস।

 

সকালে উঠলাম একটু বেলায়। প্রায় দেখি ৭টা বাজে। সকালের সাধনা হলোনা। একটু উত্তেজিতও লাগছে। কোথায় যাবে আজ নিয়ে আমাকে? ভাবলাম যা হবে দেখা যাবে। গুরু আছে। সে বুঝবে। রেডি হয়ে বেরোলাম সাক্ষী গণপতি মন্দিরের দিকে।

 

কিন্তু যাবো কি ভাবে। এতখানি তো হেঁটে যেতে পারবো না। একটা অটো নিতে হবে। একটু এগিয়ে অটো ভাড়া করলাম। শেয়ার অটো। বললো ৫০টাকা দিতে হবে। তাই রাজি হলাম। বাকিরা সব ঘুরবে ও আমায় শুধু গণপতি মন্দিরের সামনে ড্রপ করে দেবে। উঠে পড়লাম।

 

কাল যে পথে হেঁটেছি সেই একই পথ। কেন যে হাটলাম আর কিভাবে হাঁটলাম নিজেরই অবাক লাগছে। প্রায় ১৫মিনিট লাগলো অটোতে। পৌছালাম সাক্ষী গণপতি মন্দিরে। ওখানে নামিয়ে দিলো অটো। বাকিরাও নামলো। কাছেই ফুল আর নারকেল কিনে পুজো দিতে গেলাম। পুরোহিত আছে পুজো করিয়ে দিলো। গণপতি কে বললাম, বোলো তোমার বাবাকে আমি এসেছিলাম। সেতো আর মনে রাখে না। তুমিই কন্ফার্ম করো তাকে। ভুলে যেও না। অনেক বার করে বললাম। আর বললাম অনেক ধন্যবাদ। ঘোরা বেশ বিঘ্নহীন হলো, পুজো প্রার্থনা শেষ। নারকেল ফাটানো হলো। বেরিয়ে এলাম মন্দির থেকে।

 

এবার ফিরবো। কিছু চাই। রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছি। দেখি ওই সন্ন্যাসী। ইনি আবার এখানে কখন এলেন। আমাকেই তো বলতে পারতেন, তাহলে আমার সাথেই আসতেন। তোমার তো গোপূরণ দেখা হয়নি। চলো দেখবে।

 

আমি তো ভুলেই গেছিলাম সেকথা। উনি মনে করিয়ে দিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম আপনি তো আগেই বলতেন। এর জন্য কষ্ট করে এলেন। আপনার কাছে অজানা তো কিছু নেই।

 

বললেন আসতে আমার কোনো কষ্ট নেই। কিন্তু সাধনায় এই শরীর ধরে রাখা আর যাবেনা। একটা ফাঁকা অটো স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে উনি কিছু বললেন ওখানকার ভাষায়। আমাকে অটোতে বসতে বললেন।

 

আজ আমি মানুষটাকে দেখতে লাগলাম ভালো করে। গোটা মুখে বলি রেখা। বয়সের ছাপ থাকলেও এত বয়েস মনে হয় না। দেখে মনে হয় আশির কাছাকাছি হবে। পৌছালাম সেই শিখরমের কাছে যেখানে শিখরেশ্বরে মন্দির। অটো কে ভাড়া জিজ্ঞেস করলাম বললো ৩০টাকা। দিয়ে ওপরে উঠতে থাকলাম। ওনাকে দেখে ওপরের মন্দিরের পূজারী বেশ সম্ভ্রম দেখিয়ে সরে দাঁড়ালো। উনি মন্দিরে ঢুকে মহাদেব কে অভিষেক করলেন।


আমি বাইরেই। বললেন প্রণাম করে ওপরে চলো। প্রণাম করে উপরে উঠলাম। কাল যেদিক থেকে গোপূরণ দেখার চেষ্টায় ছিলাম ওদিকে যেতে বললেন ওদিকে নয় এদিকে এস। সরিয়ে নিয়ে গেলেন নন্দী মহারাজের দিকে। আমায় বললেন নন্দীর মুখ যেদিকে ভগবান তো ঐদিকেই থাকবে।

 

গেলাম। বললেন দেখো এবার। পরিষ্কার গোপূরণ দেখতে পেলাম। ওদিন তো কত চেষ্টা করলাম। কেউ তো বলতেই পারলোনা। দেখে প্রণাম করলাম। আবার সেই একই ভাবে নন্দী মহারাজের কানে কানে বললাম। সব পর্ব মিটলে বললেন নিচে যাই। নেমে এলাম নিচে। দেখলাম কয়েকজন দর্শনার্থী নিচে এসেছেন। আমরা যে অটোতে এসেছি সেটি দাঁড়িয়ে আছে।

 

মহারাজকে জিজ্ঞেস করলাম বাকি পথ তাহলে এই অটোতেই যাই। উনি এগিয়ে গিয়ে অটোর সাথে কথা বলে আমাকে ইশারায় উঠতে বললেন। উঠে বসলাম। অটো মন্দিরের দিকে এগোলো।

 

বাস স্ট্যান্ডের আগের চৌরাস্তার মোড়ে অটো থামলো। দুজনে নামলাম। অটোকে ৬০টাকা দিতে বললেন মহারাজ। দিলাম। উনি বললেন আমি এবার যাবো। তুমি ভালো করে খাওয়া দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নাও। তিনটের সময় রুম ছেড়ে দিও।

 

সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় থাকবো রাতে। বললেন সে ব্যবস্থা আমার। তুমি নদীর ধারেই আসবে। তোমায় বলেছিলাম তোমায় আমার প্রয়োজন আছে। আর আজ দেখাবো তোমায় জঙ্গলের মধ্যে সেই কালী মন্দির। যেখানে আজও কাপালিকরা সাধনা করে।

 

জিজ্ঞেস করলাম আমাকেও কি বলি দেবেন ঠিক করেছেন নাকি। হাসলেন খুব। বললেন না না। তোমাকে ওই স্থান দেখিয়ে নিয়ে যাবো আরও ভেতরে। বললাম জঙ্গলের মধ্যে থাকবো কোথায়? আর এই জঙ্গলে তো সব রকমের স্বাপদ আছে। বাঘ, নানা জাতের সাপ, এছাড়া আরও কি কি যে আছে তার তো কোনো ইয়ত্তা নেই। বললেন তোমার কোনো ভয় নেই। সব ব্যবস্থা থাকবে। এখন এতো প্রশ্ন করো না। চুপ করলাম। বললাম আর একটা কথা আমার সঙ্গে তো কম্বল নেই। প্রচন্ড ঠান্ডা তো। বললেন একদিনের অভিজ্ঞতায় তো বুঝেছো ঠান্ডা গরম সব অনুভূতিতো চলে গেছিলো। তাহলে এতো ভয় কেন। আর তোমার সঙ্গে কি আছে আর কি নেই সবই আমি জানি। এখন যাও। নমঃ নারায়ণ বলে পিছনে ঘুরে গেস্ট হাউসের দিকে ফিরে চললাম।

 

রাস্তায় ভাবছি কি প্রয়োজন এনার আমাকে। দিব্যি তো স্বয়ং সম্পূর্ণ মানুষ। কিছুই নেই অথচ সবই আছে। যেখানে খুশি যেতে পারে। খাওয়া আর পোশাক নিয়েও কোনো চিন্তা নেই। পৌছালাম রুমে। হারিথা বলে একটা restaurant আছে আমার গেস্ট হাউসের পাশে। ওখানে নর্থ ইন্ডিয়ান থালি পাওয়া যায়। ভাবলাম যদি বলি ও দেয় তাহলেও খেয়ে নিই আগে। এই রসম সাম্বার খেয়ে হবে না। আর জঙ্গলে যে কতদিন রাখবে কে জানে।

 

স্নান সেরে নিচে নেমে গেলাম খেতে। খাওয়া পর্ব যখন মিটলো তখন ঘড়িতে প্রায় ১২টা। উঠে গেলাম একটু ঘুমাবার জন্য। তিনটের সময় পৌঁছাতে বলেছে মহারাজ।

 

ঘুম থেকে উঠলাম তখন বাজে আড়াইটে। চা তো পাবো না। আড়মোড়া ভেঙে উঠে সিগারেটে ধরালাম। রেডি হচ্ছি, চেক আউটও করতে হবে। একটাই ব্যাগ। কিন্তু বিপদে পড়লাম ওই ধুতির কি হবে। কিভাবে এখন ফেরত দেব? ব্যাগেই নিয়ে নিলাম আপাতত। দেখি কি দাঁড়ায়। ফিরবো তো। ফেরার সময় দেব। সব গুছিয়ে নিয়ে নিচে নামলাম।

 

কাউন্টারে পেমেন্ট করে নদীর দিকে এগোলাম। যেখানে গাড়ি থাকে ওখানে একটা চায়ের দোকান আছে। চা বললাম। চা খেয়ে নদীর দিকে এগোবার আগে চৌরাস্তা মোড়ে দাঁড়িয়ে প্রণাম করলাম মল্লিকার্জুন স্বামীকে। প্রণাম জানালাম ভ্রামরী মাকে। এগোলাম। ঘড়ির কাঁটা প্রায় তিনটে নামলাম নদীর ধারে সিঁড়ি তে। দেখি কেউ নেই।

 

একটা কেমন উত্তেজনা হচ্ছে ভেতরে। ধরিয়ে ফেললাম আরও একটা সিগারেট। সিগারেট প্রায় শেষের পথে সন্ন্যাসী এলেন।

 

বললেন এই যাত্রায় তুমি এমন কিছু ঘটনার সাক্ষী থাকবে যা তোমার সারাজীবন মনে থাকবে। অহেতুক দুশ্চিন্তা বা উত্তেজনা এন না। শান্ত হও।

 

তুমি কি জানো এই অন্ধ্রপ্রদেশ কে অন্ধ্র দেশম বলা হতো অনেক আগে। বললাম না, জানিনা। (আমি যখন শ্রীশৈল যাই তখনও অন্ধ্র এবং তেলেঙ্গানা ভাগ হয়নি ) এই অন্ধ্র দেশম কে ত্রিলিঙ্গ দেশম বা ত্রিলিঙ্গ ক্ষেত্র ও বলে। কারণ এখানে তিনটি স্বয়ম্ভূ  শিবলিঙ্গ আছে। এগুলি হলো ভীমেশ্বরম এটি দ্রাক্ষারমমে, কালেশ্বরম যেটি করিমনগরে আর শ্রীশৈলে মল্লিকার্জুন স্বামী।

 

শুনলাম। জিজ্ঞেস করলেন খাওয়া দাওয়া করেছো তো ভালো করে। বললাম হ্যাঁ। দাও তোমার এক খানা সিগারেট দাও। দিলাম। দুজনেই ধরিয়ে বসলাম। মনের উত্তেজনা কিছুতেই কমছে না। উনি যতই বলুন। সিগারেটে কয়েকটি টান দিয়ে বললেন আরও একটি জায়গা আছে তা হলো পীথাপুরম বা পিঠাপুরম। এখানে আছেন মা পুরোহিতা দেবী। ভৈরব হলেন কুকুটেশ্বর স্বামী। মহাদেব এখানে কুকূট বা মুরগির রূপে এসেছিলেন। সেই রূপের ওপর ঢাকনা দিয়ে লিঙ্গ আকার দেওয়া হয়েছে।

 

বললাম এসব তো জানি না। আপনার মুখে শুনলাম প্রথম। উনি বললেন এই পিঠাপুরম ও দ্রাক্ষারামম এই দুই শক্তিপীঠ। আদি শঙ্করের নির্দেশিত ১৮ শক্তিপীঠের মধ্যে পড়ে।

 

শ্রীশৈলে যেমন দেবীর গ্রীবা পড়েছে, তেমনি দ্রাক্ষারমমে পড়েছে বাম গাল। আর পিঠাপুরমে পড়েছে বাম হাত। এতো কিছু আমার মনে থাকবে না। ব্যাগ থেকে নোটবুক বার করে লিখতে বসলাম। লিখে রেখে বললাম আমিতো আর এখন এসব জায়গায় যেতে পারবো না। আপনি বললেন জানা হলো। তখন তো আর বুঝিনি ভদ্রলোক আড়ালে হাসছেন।

 

বললাম জঙ্গলে যাবেন বললেন। কখন যাবেন? যাবো। দাড়াও ওই নৌকায় ওঠো। একটু দূরে নৌকা আছে। ওরা পাতাল গঙ্গায় ঘোরায়। আমার তখন পাতাল গঙ্গায় ঘোরার তেমন ইচ্ছা নেই। একটু ইতস্তত করছিলাম।

 

উঠলাম নৌকায়। আমরা দুজন। ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম কত টাকা দিতে হবে। উনি বললেন কিছু লাগবে না। মাঝি যে ওনাকে ভালোই চেনেন বোঝা গেলো। তার বডিল্যাংগুয়েজে বুঝলাম সে এনাকে খুব শ্রদ্ধা করেন। ভাষা বোঝা আমার দ্বারায় হবে না। শীতের নদী, জল বেশ কম। নৌকা এগিয়ে চললো। অনেকক্ষণ গেলো। দুপাড়ের পাহাড়ের দৃশ্য বেশ সুন্দর। জঙ্গল আর পাহাড় মাঝে জল। নিজেরই কেমন মনে হতে লাগলো এক আদিম ভ্রমণ। প্রায় ঘন্টা খানেক কাটলো। একটা জায়গায় ছোট ঘাট মতো। নৌকা ধীর হলো। ঘাটের কাছে থামলো। ঘন জঙ্গল দুপাশে। ওনার ইশারায় নামলাম। আলো কমছে ধীরে ধীরে। বেশ ভয় ভয় করছে। এমন তো কখনো আসিনি।

 

উনি আমাকে আগে নামতে দিয়ে পরে নেমে এলেন। নৌকা একটু দাঁড়ালো। উনি কি একটা ইশারা করলেন হাতের ইঙ্গিতে। মাঝি লোকটি কান এঁঠো করা একটা হাসি দিয়ে নৌকা নিয়ে ফিরে চললো।








Share this Page

Subscribe

Get weekly updates on the latest blogs via newsletters right in your mailbox.

Thanks for submitting!

bottom of page