Aবং হলো ১৯৮০ সাল থেকে তার সাধনার জীবনের নানা কাহিনীকে তুলে ধরা। পূর্ব জীবনকে জানার জন্য অবধূত নানা কাজের সূত্রেও সেই সব জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন সঙ্গে মিলিয়ে নিলেন নিজের জীবনের ছন্দকে। অবধূতের জীবনের নানা ঘটনাকে তুলে ধরা হবে এই Aবং বিভাগে। তাঁর শ্রীশৈলম ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এখানে দেওয়া হলো পর্বে পর্বে। আজকে চতুর্থ পর্ব।
উনি এগিয়ে গেলেন। আমি ফাঁকা দেখে একটা জায়গায় বসলাম মন্দিরের মূল গর্ভ গৃহের পিছনের দিকে। গোটা শরীরে তখনও সেই বিদ্যুৎ এর অনুভতি। একমনে গুরুকে স্মরণ করে গুরু প্রদত্ত সঞ্জীবনী মন্ত্রের বিশেষ সাধনা শুরু করলাম।
খানিকক্ষণের মধ্যে মনে হলো জ্যোতির্লিঙ্গ থেকে যেন ক্রমাগত নিঃস্বরিত এক শক্তি আমার সমস্ত শরীর কে ভরিয়ে দিচ্ছে। এক প্রচন্ড তেজ তার। আমি যেন বসে থাকতে পারছি না। বেশিক্ষন বসেও থাকতে পারলাম না, বুঝলাম আজ আর হবে না। উঠে পড়লাম। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম ভ্রমরাম্বিকা মন্দিরের দিকে।
মন্দিরের ভিতরে দক্ষিণ ভারতীয় ঘরানায় ভ্রামরী দেবীর মূর্তি। নানা অলংকারে দেবী ভূষিতা। মূর্তির সামনে একটি বিরাট শ্রীযন্ত্রম। দুজন পুরোহিত ললিতা সহস্রনাম পাঠ করছেন এবং কুমকুম অর্পণ করছেন শ্রীযন্ত্রের ওপরে। গর্ভ গৃহে প্রবেশ করতে কাউকে দিচ্ছেন না। গর্ভগৃহের মূল ফটকে একজন মহিলা সিকিউরিটি দাঁড়িয়ে। সবাই লাইন করে আসছে একটু দাঁড়িয়ে প্রণাম করছেন আর এগিয়ে যাচ্ছেন।
প্রণাম করলাম দাঁড়িয়ে। দেবীর কাছে প্রার্থনা করছি দেখলাম ভ্রমরের গুঞ্জনের শব্দ অত্যন্ত স্পষ্ট। একটু পিছনে সরে এসে পরের মানুষটিকে জায়গা করে দিলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম এই ভ্রমরের শব্দ কিভাবে আসছে। বুঝলাম মন্দিরের নির্মাণ শৈলী এমন, যাতে হাওয়া এমন ভাবে এখানে ঢুকছে সর্বদা এই আওয়াজ পাওয়া যাবে। একটু দাঁড়িয়ে গুরুপ্রদত্ত বীজমন্ত্র জপ করে দেবীকে প্রণাম করলাম। বুঝলাম কেন এখনো সিদ্ধ যোগীরা শ্রীশৈলমকে এতো প্রাধান্য দেয়। ধীরে ধীরে নেমে গেলাম। সঙ্গের মোবাইল তো গেটে জমা আর ঘড়িও ওই সিকিউরিটি রুম এ রেখে দেওয়া। সময় বুঝতে পারলাম না। তবে ভীড় একদমই নেই, মন্দির চত্বর সম্পূর্ণ ফাঁকা। দু-চারজন দর্শনার্থী ছাড়া।
এই ভ্রামরী দেবী যাকে এখানে ভ্রমরাম্বিকা বলা হয় তাঁর কথা পরে বলবো। এবার গেট থেকে বেরোতে হবে। তবে তার আগে পোশাক পরিবর্তন দরকার। ফিরে চললাম মূল ফটকের কাছে। যেখানে আমার জামা প্যান্ট সব রাখা। দেখলাম যাকে পূজারী ভদ্র্লোক দ্বায়িত্ব দিয়ে গেছিলেন সে একনিষ্ঠ ভাবে দাঁড়িয়ে। তাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে ভিতরে গিয়ে পোশাক পরিবর্তন হলো। বেরিয়ে এসে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম ধুতিটি কোথায় রাখবো। ছেলেটি বললো "পানতুলুগারু" কে ডেকে দিচ্ছি। তুমি এখানে দাড়াও।
দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রায় মিনিট দশেক পরে উনি এলেন। হাতে একটি ব্যাগ। বললেন ওতে রেখে দিতে আর আমার সঙ্গে রাখতে। আর চলে যাবার সময় ফেরত দিতে। বললেন পরে আবার ঢুকতে গেলে কিন্তু ধুতি লাগবে। সংকোচ বোধ হলেও নিলাম। কারন এখানে আবার একটি ধুতি কিনতে গেলে কিছু খরচ হবে তার চেয়ে ওই টাকাটুকু বাঁচবে। এমনিতে খুব সামান্য টাকা নিয়ে বেরিয়েছি।
জিজ্ঞেস করলাম "পানতুলুগারু" কথাটি ছেলেটি বললো। এর মানে কি? উনি হাসলেন। বললেন ওখানকার স্থানীয় ভাষায় এই শব্দটির মানে পূজারী। বললেন খুব ভালো লাগলো তোমার সাথে আলাপ হয়ে। তোমার ব্যাপারে জানলাম থানার ওই কাগজ থেকে। আমি নিজেই জানিনা কি লিখেছেন অফিসার। শুধু মাথা নাড়লাম।
জিজ্ঞেস করলেন দীক্ষা হয়েছে? তুমি কি সাধক? বললাম হ্যাঁ। দীক্ষার ও সাধনার কথা শুনে একটু অবাক হলেন। একই জায়গায় জ্যোতির্লিঙ্গ এবং এমন জাগ্রত শক্তিপীঠ খুব কম আছে। জিজ্ঞেস করলেন কদিন আছো? বললাম কয়েকদিন আছি। ফেরার কোনো নির্দিষ্ট দিন নেই। এসেছি ভালো ভাবে দেখবো, অনুভব করবো, তারপর। বললেন যেকদিন আছো এস। বললেন ঠিক জায়গা থেকে শুরু করলে। একই জায়গায় জ্যোতির্লিঙ্গ এবং এমন জাগ্রত শক্তিপীঠ খুব কম আছে।
অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে কুপন দিচ্ছেন দেবস্থানমের ভজনালয় তে খাবার জন্য। কুপন নিলাম। গেট থেকে বেরিয়ে (এক্সিট গেট) বাম দিকে একটু এগিয়ে ডান হাতে পড়লো প্রসাদ নেবার জায়গা।
গেলাম প্রসাদ নিতে। বেশ বড়ো আকারের একটি লাড্ডুর মতো প্রসাদ। পেলাম। প্রসাদের জন্য কুপন আছে। আগে কুপন কেটে নিতে হয়। প্রসাদ নিয়ে এগিয়ে যাবো একটি বছর চারেকের ছেলে ইশারায় দেখালো ওর খুব খিদে পেয়েছে। ওর দিকে তাকিয়ে মনে হলো মহামৃত্যঞ্জয় যেন নিজেই প্রসাদ চাইতে এসেছেন। হাটু গেড়ে বসে হাতের সব প্রসাদ ওর হাতে তুলে দিলাম। মুখটা খুশিতে ভোরে গেলো। নিজের জীবন যেন স্বার্থক মনে হলো। দেখলাম বসে পড়লো ও খেতে শুরু করলো। আমিও বসে পড়লাম ওর পাশে।
মনে পড়ে গেলো আমার গুরুর কথা। বারবার বলেন কাউকে দান দিয়ে কাউকে করুণা করছো মনে করো না । কখনো ভেবোনা তাকে উপকার করলে। দান গ্রহীতা খুব কম। তিনি দেবতা। মনে রাখবে দান তিনি দয়া করে নিয়েছেন বলে তুমি কৃতার্থ হয়েছো।
মনে পড়ে গেলো আমার গুরুর কথা। বারবার বলেন কাউকে দান দিয়ে কাউকে করুণা করছো মনে করো না । কখনো ভেবোনা তাকে উপকার করলে। দান গ্রহীতা খুব কম। তিনি দেবতা। মনে রাখবে দান তিনি দয়া করে নিয়েছেন বলে তুমি কৃতার্থ হয়েছো। আমি পাশে বসে ওর খাওয়ার দিকে চেয়ে রইলাম। কি পরম তৃপ্তিতে সে খাচ্ছে। খাওয়া শেষ হতে পাশে খাওয়ার জলের কলের কাছে গেলো। কিন্তু ছোট্ট শিশু তার হাত পৌঁছায় না। এগিয়ে গিয়ে কোলে নিয়ে উঠিয়ে ধরতে দুহাত ভোরে জল নিয়ে খেলো। মাথা নাড়তে নামিয়ে দিলাম।
কি সব তার কচি গলায় আমাকে বললো। সে ভাষা আমি জানি না। শুধু ওর হাসিটা আমাকে এক দারুন আনন্দ দিলো। যেন কোনো দেবশিশু হাসছে। টাটা করে এগিয়ে গেলাম।
একটু এগোতে ভোজনালয়। ডানদিকেই পড়বে। ঢুকলাম ভিতরে। দারুন ব্যবস্থা। অনেকটা শিরিডির ভোজনালয়ের মতো। খাবার দিলো কত রকম। প্রথমে সাদা ভাত, সাম্বার, ভাজা, একটি সবজি পাঁপড়। যত খুশি খাওয়া যাবে। তারপর এলো পোলাও এবং পনীর। সেটাও যত খুশি দেবে। পেটভরে খেলাম। উঠতে যাচ্ছি বললো বসুন পরমান্ন দেওয়া হবে। এলো পায়েস। খেয়ে উঠলাম। হাত ধুয়ে বেরিয়ে মূল ঢোকার গেটের দিকে এগোলাম, কারন মোবাইল নিতে হবে জমা আছে। এগিয়ে দেখি বেশির ভাগ কাউন্টার বন্ধ। মাত্র দুটি খোলা। কুপন দেখতে চাইলো। দিলাম। মোবাইল ফেরত দিলো।
এবার জুতো নেবার পালা। জুতো নিলাম। এগিয়ে চললাম মল্লিকার্জুন সদনের দিকে মন্দিরের সোডিয়াম ভেপারের তীব্র আলোর উজ্জ্বলতা ক্রমে ম্লান হতে লাগলো। অন্ধকার বাড়তে লাগলো। রাস্তার স্ট্রিট লাইটের আলোর কম তীব্রতা যেন তখন চোখে লাগছে। মনে হলো অন্ধকার আছে বলেই তো আলোর এতো কদর।
ধীর পায়ে এগোচ্ছি। প্রায় মিনিট পাঁচেক হাঁটা। একটা সিগারেট ধরালাম। দুচার টান মেরেছি সবে আর ভাবছি ফাইনালই তাহলে বেরোনো হলো হটাৎ সমস্ত শরীর যেন কেউ ঝাঁকাতে লাগলো। এতো তীব্র সেই কম্পন। চারদিকে তাকালাম। তাহলে কি শরীর খারাপ হলো। এমন তো কখনো হয় না। রাস্তার পাশে মোবাইল বাথরুম একটা তার ঠিক কোনাকুনি বড়ো সিমেন্টের চেয়ার ট্রেন স্টেশনের মতো গিয়ে বসে পড়লাম। সিগারেটে আরও দ্রুত কয়েকটি টান দিয়ে ফেলে দিলাম। তখনও এক তীব্র কম্পন গোটা শরীরে। চোখ বন্ধ করে গুরু স্মরণ করলাম। গুরু প্রদত্ত্ব মন্ত্র জপ করছি। কেমন এক অতীন্দ্রিয় অনুভূতিতে মনটা ভোরে গেলো। শরীর বেশ গরম হয়ে উঠেছে। নিজের গায়ের তাপ নিজে বুঝতে পারছি। ভাইব্রেশনটা থেমে গেল।
তখনো চোখ খুলতে পারিনি। চোখের পাতা যেন অস্বাভাবিক ভারী। কেমন একটা অনুভূতি হলো যেন সামনে কেউ দাঁড়িয়ে। খুব ধীরে ধীরে চোখ খুলতে পারলাম।
খুলেই প্রায় ভূত দেখার মতো দেখলাম। কৃষ্ণা নদীর ঘাটে দেখা বৃদ্ধ সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে। বিশুদ্ধ বাংলায় বলে উঠলেন মায়ের ওপর রাগ হয়েছিল? হতভম্ব হয়ে গেলাম। হা করে তাকিয়ে আছি। যে লোকটি সন্ধ্যা বেলায় হিন্দিতে কথা বললেন তিনি বিশুদ্ধ বাংলায়। যিনি বললেন কাল এস কথা হবে, আর এখন এখানে দাঁড়িয়ে। যথেষ্ট বৃদ্ধ। দেখে মনে হয় যার পক্ষে বেশি হাঁটা চলা করা কষ্টকর তিনি কিভাবে এখানে ? বিস্ময়ের ঘোর যেন কিছুতেই কাটছে না।
আবার জিজ্ঞেস করলেন মায়ের ওপর রাগ হয়েছিল অনুভূতি পাওনি বলে? তোমার গুরু তো তোমায় বলেছেন নেগেটিভ -পসিটিভ, ভালো -মন্দ, এসব অনুভূতি নিয়ে মাথা না ঘামাতে। তাহলে এখনো এসব নিয়ে চলছ কেন?
ভাবছি উনি জানলেন কি করে আমার মনের কথা ? আর আমার গুরু কি বলেছেন তাই বা ওনার কাছে কি করে খবর হলো। আমি কি ঠিক শুনছি। উঠে যেন দাঁড়াবারও শক্তি নেই। দুহাতে চোখটা কচলে নিয়ে আবার দেখলাম। ভ্রম না সত্যি।
ওনাকে সম্মান জানবার জন্য উঠে দাঁড়াতে গেলাম। ভালো করে দাঁড়াতেও পারছিনা। বললেন বস। এতো শক্তি ধারণ করার ক্ষমতা তোমার এখনো হয়নি। ধপ করে বসে পড়লাম। উনি দাঁড়িয়ে রইলেন। সাধন ভজন তো করোনা। দেবদেবীও খুব যে মানো তাও নয়। গুরুই তোমার সব। মাটিতে যেন মিশে যাচ্ছি। ভাবছি যিনি আমার মনের সবকথা জানেন তিনি তো খুব উচ্চ কোটির মানুষ। শুধু মনের নয়, কি করি আর না করি তাও। আমার গুরু কি বলেন তাও। মনে পড়লো প্রথম সাক্ষাতে তো আমার দীক্ষার কথা বলেছিলেন।
বললেন অনেক বেশি সাধনা তোমার দরকার। আধার এখনো তৈরী হয়নি এই শক্তি ধারণের। দেবী এস্থানে নিত্য বিরাজিত। অত্যন্ত উগ্রশক্তি রূপিণী। আর এইভাবেই উনি এখানে আছেন। অভিমান করতে পারো মায়ের কাছে রাগ করো না। শুধু তোমার গুরু তোমাকে আজ রক্ষা করলেন। এই তীব্র শক্তি ধারণ করার ক্ষমতা খুব কম মানুষের হয়। এস্থান মাহাত্য কৈলাশের সমান। তাই একে দক্ষিণের কৈলাশ বলা হয়। ধরেনাও কৈলাশ দিয়েই তোমার যাত্রা শুরু করেছো।
তুমি তো জানো অবধূত হলেন সেই মানুষ যিনি মানুষ থেকে শিব হয়েছেন। তোমার ইষ্ট ও অবধূত। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন ছাড়াও যে অতীন্দ্রিয় জগৎ জানতে তোমার এতো আগ্রহ তার কিছু উপলব্ধি হবে তোমার এই ভ্রমণে। ঈশ্বরে তোমার মতি হোক। সাধন বাড়াও। এখন ফিরে যাও। হাতটা ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিলেন সোজা উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। গায়ের ওই উত্তাপ যেন নিমেষে গায়েব। বললেন যাও। বিশ্রাম কর।
ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম মল্লিকার্জুন সদনের দিকে। রুমে কোনো রকমে ঢুকে ওই পোশাক পরা অবস্থায় বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ঘড়ি দেখলাম হাতে নেই। প্যান্টের পকেট থেকে বার করে দেখলাম রাত সাড়ে ১১টা। মোবাইলও বার করে দেখলাম বন্ধ। ঘুমিয়ে পড়লাম। লাইটও নেভাতে পারলাম না উঠে।
একটা হিমশীতল হাত যেন কপালে। মানুষের হাত এতো ঠান্ডা হয় জানা নেই। ঘুমের ঘোরে সরাতে গেলাম। কি শক্ত রে বাবা। ক্ষমতা হলো না। উঠে পড়ো। চোখ খুলে দেখি সেই বৃদ্ধ সন্ন্যাসী।
উনি কি করে ঘরে এলেন। দরজা তো ভিতর থেকে বন্ধ। আমিতো নিজে বন্ধ করেছি কাল রাত্রে। দ্রুত দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ছিটকিনি তো আটাই আছে। ভয়ে কেমন সিঁটিয়ে গেলাম। ভূত নাকি? এখানে তো অনেক কাপালিকদের আড্ডা ছিল একসময়। নরবলি হতো নিত্য। এমনি কোনো মহাত্মা কে হয়তো বলি টলি দিয়েছিলো।
গুরু অবধূত তো বলেছিলেন, বইতেও পড়েছি আদি শঙ্করাচার্যকেও এখানে বলি দিতে কাপালিকরা নিয়ে গেছিলো। শুধু ওনার শিষ্যের বুদ্ধিমত্যার জন্য বেঁচে গেছিলেন।
এখন উঠে পড়ো, হাসতে হাসতে বললেন যা ভাবছো আমি তা নয়। কেমন করে এলাম পরে জানাবো। এখন চলো মন্দিরে। বাকি সব রেখে ধুতি পরে আমার সাথে এস। ঘড়ি দেখলাম রাত তিনটে। বাইরে ঠান্ডা আছে গায়ের চাদর টা জড়িয়ে নিয়ো।
নির্দেশ মতো করে চলেছি। দরজা খুলে বেরিয়ে বললেন এস, আমি এগোচ্ছি। চোখের পলকে দেখলাম নেই। গোটা করিডোর শুনশান। কেউ কোথাও নেই।
ঘরে চাবি দিয়ে এগোলাম মন্দিরের পথে। বাইরে বেশ ঠান্ডা। শীতে কেঁপে যাচ্ছি। হিহি করতে করতে মন্দিরের রাস্তা ধরলাম। বাথরুম, স্নান মুখ ধোয়া কিছুই হয়ে ওঠে নি। সিগারেটের নেশা তখন উঠেছে। ধুতির একজায়গায় ভাগ্গিস কিছু টাকা বেঁধে নিয়েছিলাম। কিন্তু এতো ভোরে কি দোকান খোলা পাবো। একটু এগোতে রাতের সেই জায়গাটা দেখলাম যেখানে বসে পড়েছিলাম। আর একটু এগোতে কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। দুজন ড্রাইভার দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। চক্ষু লজ্জার মাথা খেয়ে এগিয়ে গিয়ে একটি সিগারেট চাইলাম। প্রায় মত্ত অবস্থায় দুজন। গাড়ির বনেটের ওপর বোতল খোলা। একজন জামার পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে দিলো। ধরিয়ে একটু পেছনে এসে কালকের জায়গায় বসলাম।
নিজেকে যেন একটু সামলাতে পারলাম। ভাবছি সন্ন্যাসী এলো কি করে। দরজা তো বন্ধ। খানিকটা খেয়ে সিগারেট ফেলে উঠে পড়লাম মন্দিরের উদ্দেশ্যে। রাস্তা সুনসান। কুকুর রাস্তায় কুন্ডলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। দোকান সব বন্ধ। ভেপার ল্যাম্পের আলোর চারদিকে পোকাদের আচ্ছাদন। জুতো খোলার জায়গায় পৌঁছে গেলাম। কিন্তু কেউ তো কোথাও নেই।
একি সেই নিশি ডাক! সিকিউরিটিরাও ঘুমোচ্ছে চেয়ারে বসে। চারদিকে তাকিয়ে সন্ন্যাসী কে খুঁজতে লাগলাম। মূল ফটকের বামদিক থেকে সন্ন্যাসী কে আস্তে দেখলাম। ইশারায় ডাকলেন আমাকে।
এগিয়ে গেলাম ওনার দিকে। ওই ঠান্ডায় কোমরে সামান্য একটি কাপড়। গোটা গায়ে আর কিছু নেই। আমি তো ঠান্ডায় প্রায় কাঁপছি। আমাকে নিয়ে চললেন। যেখানে মোবাইল রাখা হয় তার পাশ দিয়ে নিয়ে গিয়ে একটি ছোট্ট গেট খোলা তা দিয়ে ভিতর নিয়ে গেলেন। গোটা মন্দির চত্বর নিস্তব্ধ। ভ্রমরাম্বিকা মন্দিরের পিছনে নিয়ে গেলেন। তারপর কিছুটা ফাঁকা জায়গা। সারি দিয়ে ছোট ছোট মন্দির। ওই ছোট্ট করিডোরে বসতে বললেন। বসলাম।
আমাকে বললেন মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তোমার। আমি জানি। তার উত্তর পাবে পরে। এখন যা বলছি করো। একদম সোজা হয়ে বস। বসলাম। বললেন আগে মন দিয়ে শোনো। প্রথমে নাড়ি শুদ্ধি করবে, তার আগে গুরুকে বিশেষ ভাবে আবাহন করবে। অনুভব করতে পারবে তিনি এসেছেন। তারপর গুরু নির্দেশিত পথে সাধনা শুরু করবে। যা চাইছিলে তখন বুঝতে পারবে। শেষ হলে আমি তোমায় ডাকবো। তখন উঠবে। এটা ব্রহ্ম মুহূর্ত। একদম সময় নষ্ট করো না।
নাড়ি শুদ্ধির পর গুরু আবাহন শুরু করলাম। খানিক ক্ষণ সময় গেল। চাদরে একটা টান পড়লো। প্রথমে আস্তে তারপর জোরে কেউ যেন চাদরটা খুলে দিলো। কোনো ঠান্ডা আর লাগছে না। বীজ মন্ত্র জপ যেন আপনিই শুরু হয়ে গেলো।
এক অচৈতন্য অবস্থায় যেন চলে গেলাম। জানিনা কত সময় গেছে। আর কি হয়েছে। কেউ যেন ডাকলো গায়ে হাত দিয়ে। সম্বিৎ এলো। আকাশ তখনো ঘর অন্ধকার। মন্দির চত্বরে বেশ কোলাহল। চারদিক ধোয়া হচ্ছে। মনে হচ্ছে খুব জ্বর হয়েছে আমার। সন্ন্যাসী বললেন চলো। বেরিয়ে যাই। গায়ের চাদরটা পড়ে ছিল নিচে, তুলে নিয়ে তার সাথে চললাম। পিছনের গেট দিয়ে বার করে নিয়ে চললেন নদীর দিকে।
সিঁড়ি দিয়ে নামার আগে যেখানে সাধুদের তাঁবু, সেখানে একটি চায়ের দোকান খুলেছে। আমায় নিয়ে গেলেন ওখানে। বললেন চা খেয়ে নাও। ভালো লাগবে। দোকানের ঘড়িতে দেখলাম চারটে বাজলো। চা বললাম দুজনের। গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। ওই তীব্র ঠান্ডা আমার কোনো অনুভূতি হচ্ছে না।
চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম এখন কি প্রশ্ন করতে পারি বললেন না পরে। নদীর ধারে গিয়ে কথা বলবো। আমি দোকানির কাছে সিগারেট চাইলাম যা আমার স্বভাব। ওনাকে জিজ্ঞেস করতে বললেন আমার কাছে বিডি আছে। তুমি খাও। আমি তো ঘন্টা কিছু আছে বলে দেখতে পাচ্ছি না। পাতলা একটুকরো কাপড় পরনে। না আছে ঝোলা না কিছু। কোথায় তাহলে বিড়ি? কিছুই মাথায় ঢুকছেনা। সিগারেট নিয়ে ধরিয়ে বললাম আবার ওই ১৫০ সিঁড়ি ভেঙে নাম ওঠা করতে হবে। এখানে বলুন না।
১৫০সিঁড়ি বলে, হোহো করে হেসে বললেন সবে তো তোমার হাঁটা শুরু হয়েছে। আরও অনেক পথ হাঁটতে হবে। তার জন্য এই হাঁটা খুব দরকার তোমার। মনে মনে ভাবছি আবার কোথায় এতো হাঁটবো এখানে। এই তো দেখা হয়ে গেলো মন্দির। আর কাছাকাছি কিছু জায়গা দেখে নেবো শেয়ার জীপ্ চড়ে ১০০টাকা ভাড়া দিয়ে। তারপর যে কদিন আছি সাধনা করবো এখানে বসে, তারপর কাশী যাবো কোলকাতা হয়ে। এসব ভাবতে ভাবতে চা সিগারেট শেষ হলো। বললেন চলো নিচে যাই। অনিচ্ছা সত্বেও শুধু প্রশ্ন গুলো জানার জন্য নিচে নামতে লাগলাম।
সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলাম। নামায়তো এত কষ্ট নেই। তাই ধীরে ধীরে নামতে লাগলাম। নেমে সন্ন্যাসীর সাথে ঘাটের ডান দিকে এগিয়ে গেলাম। উনি এক জায়গায় বসলেন। ইশারায় আমাকেও বসতে বললেন। বসলাম। বললেন দাও তোমার ওই সিগারেট। দিলাম। দেশলাই জ্বালিয়ে এগিয়ে ধরলাম। ধরিয়ে বসলেন। প্রথম যে ধোয়া টি নিয়ে ছাড়লেন এক সুন্দর সুগন্ধে চারিদিক ভোরে গেলো। আমি যেন কেমন মোহিত হয়ে গেলাম ওই গন্ধে। যেটুকু মনে বিরক্ত ছিল সব যেন পলকে গায়েব। সিগারেটের তামাকের কোনো কটু গন্ধ নেই। হো হো করে হেসে বললেন তোমার প্রথম প্রশ্ন তো বাংলায় কি করে কথা বলছি আর আমি বাঙালি কিনা।