top of page
Writer's pictureSadhguru

বাক্‌-ই ব্রহ্ম

নাদ এর প্রতিটি স্তর কে তন্ত্র সাধনে নিজ দেহে প্রত্যক্ষ করার পরে যে অভিজ্ঞতা অবধূত অদ্বৈতানন্দ পেয়েছিলেন তাকেই তার লেখায় বিবৃত করেছেন। 




বাক্‌-ই ব্রহ্ম বৃহদারণ্যক উপনিষদ থেকে পাই — বাক্‌ বৈ ব্রহ্ম ইতি। নাদের চারটি ভাগ বৈখরী, মধ্যমা, পশ্যন্তি ও পরা। আমার আগের অনেক লেখায় বৈখরী কথাটি অনেকবার এসেছে তখন অনেকেই প্রশ্ন করেছেন বৈখরী কি? সময় বা সুযোগের অভাবে আর সেই নিয়ে লেখা হয়ে ওঠেনি। আজ ছোট করে চেষ্টা করছি তার কিছুটা লেখার।


প্রাণ, অর্থাৎ শ্বাস যুক্ত হয়ে উচ্চারিত কম্পন বৈখরী বা নাদ।


প্রাণবায়ু বা শ্বাস যখন কন্ঠ, তালু, জিহ্বা ইত্যাদির অভিঘাতে উৎপন্ন হয়ে কম্পন ছড়িয়ে পড়ে বলেই তা বৈখরী। হিন্দিতে যা — বিখর গয়া। ফলে আমাদের দ্বারা উচ্চারিত কম্পন যা শব্দ তৈরী করে তা হল এই বৈখরী।


এই প্রসঙ্গে সাধনার সময় যখন কুণ্ডলিনী জাগ্রত হয়ে মূলাধার থেকে সুষুম্না পথে অগ্রসর হয় তখন প্রাণ ও অপান বায়ুর সংঘর্ষে সৃষ্টি হয় নাদের। এই শব্দ শুনতে অনেকটা উচ্চারিত শব্দের মতোই শোনায়। বা নানা প্রাকৃতিক শব্দের মত শুনতে পাওয়া যায়। প্রথম স্তরে এই নাদ খুব সুন্দর ভাবে বোঝা যায় এবং সাধক প্রথমের দিকে এই শব্দ বাইরে থেকে শুনছেন না নিজের ভিতরেই উৎপন্ন হচ্ছে বুঝতে পারেন না। এতটাই স্পষ্ট থাকে। বাচ্য শব্দের মত এই শব্দ বলেই প্রথম স্তর বৈখরী। অর্থাৎ ছড়িয়ে পড়া শব্দের মত।


নাদ, নাদ-ই কম্পন। শব্দতত্ত্বরূপ অক্ষর ব্রহ্ম থেকেই জগৎ বিবর্তিত হয়েছে। তাই ব্রহ্মকে বলা হয়েছে ‘অক্ষর’, তাই তিনি ‘ক্ষর’ অর্থাৎ পরিবর্তনশীল নন।


তন্ত্রে যেমন বলা হয়েছে আরও গভীরে গিয়ে যে বীজাক্ষর এর কথা যা নভস্থিত কম্পন বা নাদ। এর নির্দিষ্ট কম্পন এর কথা, এর চলন, ঘূর্ণন, এবং এর থেকে প্রাপ্ত তরঙ্গ দৈর্ঘ্য এবং বিস্তার সব পাওয়া সম্ভব সাধনার মধ্যে দিয়ে। প্রতিটি বীজের শক্তি এবং তার উপযুক্ত দেবতা কিভাবে বীজের সাথে যুক্ত ঠিক তেমনি উপনিষদে যেমন বলা হয়েছে বাক্‌ বৈ ব্রহ্ম ইতি। এবং এই কম্পন বা নাদ-ই আমাদের কাছে জ্ঞানকে উপস্থাপিত করে। আমরা যে নাথ যোগ সাধনা করি তাতে নাদ সাধনা একটা বড়ো মাপের সাধনা। 


এই প্রসঙ্গে সাধক এবং রাজা ভর্তৃহরি বলছেন - সব ধরনের জ্ঞানই শব্দের দ্বারা অনুবিদ্ধ হয়ে ভাসমান থাকে। - ‘অনুবিদ্ধমিব জ্ঞানং সর্বং শব্দেন ভাসতে।’ মজার কথা হলো এই শব্দতরঙ্গ এই ব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে থাকে প্রজ্ঞা স্বরূপ হয়ে।  যা আজকের ক্লাউড কম্পিউটিং। সাধক সাধনা করতে করতে যখন কোনো বিশেষ অবস্থায় পৌঁছায় তখন সাধক এই রকম কোনো তরঙ্গ পেতে শুরু করতে থাকে তাকেই তার জন্য নির্দিষ্ট নির্দেশ বা জ্ঞান ভাবে। সমস্যা শুরু সেখান থেকেই। 

এই নাদই আমাদের কাছে সকল জ্ঞানকে উদ্ভাসিত করে। এবং এই জগতে সব কিছুই সেই নাদ থেকে উৎপন্ন। কারণ প্রতিটি বস্তু বা কণার নিজস্ব কম্পন আছে। তার থেকে নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কে নাদ তৈরী হচ্ছে তা আমাদের কর্ণ দ্বারা শ্রুতি গোচর হোক বা না হোক। তাই প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি কম্পন বা নাদ একদম নির্দিষ্ট। কিরকম? এখানেই আসে কম্পন বা Vibration-এর Amplitude, Frequency, আর Wavelength এর কথা। এই কম্পনই তৈরী করতে পারে নির্দিষ্ট জ্যামিতিক আকার। তাই নাদ অক্ষর বা অপরিবতনশীল।


এখন আমরা অক্ষর বলতে বর্ণকেও বুঝি। এখন "ক" যে বর্ণ তা একটি নির্দিষ্ট জ্যামিতিক আকৃতি। শব্দ 'ক' কে আমরা একটি নির্দিষ্ট জ্যামিতিক আকৃতি দিয়েছি। যদি আরও গভীরে যাই সাধনার ক্রমে আরও ভিতরে প্রবেশ করি দেখব যে এই ক বর্ণের জ্যামিতিক চিত্র চিদাকাশে অত্যন্ত উজ্জ্বল ভাবে উদ্ভাসিত হবে এক গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে। এর প্রতিটি রেখার ব্যাখ্যা আসবে। তার দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক এবং খুব উচ্চকোটির সাধকের কাছে বহুমাত্রিক চিত্র আসবে। তার চলন এবং ঘূর্ণন থেকে তার কম্পন এবং আরও বিস্তারিত বোধ সামনে আসবে। কম্পন নির্দিষ্ট হলে আমরা কণার দ্বারা জ্যামিতিক চিত্রকে পাই।

যেমন ক এর ক্ষেত্রে বলা হয় -

বামরেখা ভবেৎ ব্রহ্মা

অধোঃ বিষ্ণু চতুর্ভুজম।

বামোর্দ্ধ চ সংযুক্তং

মহাদেব সংস্থিতম ।।

তদোপরি সমাযুক্তাং

পূর্ণমাত্রাঞ্চ সরস্বতী।

অঙ্কুশং কুণ্ডলাকারং

কালী কৈবল্যদায়িনী।।


ক এর ওপর দিক থেকে নেমে আসা বামরেখা হলেন ব্রহ্মা। বামরেখা হতে অধোদিকে অর্থাৎ নীচের দিকে নেমে আসা রেখাটি হলেন বিষ্ণু । আর, এই দুই রেখাকে সংযুক্ত করে যে রেখাটি সোজা ওপরের দিকে উঠে গেছে, সেটি হল সৃষ্টি ও স্থিতির সাম্য রক্ষাকারী দেবাদিদেব শঙ্কর । আর সর্বোপরি পূর্ণমাত্রারুপে বিরাজ করছেন বাকের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতী। আর পরাবাক্ হতে উদ্ভবা অঙ্কুশাকার যে কুণ্ডলী নেমে এসেছে তা হলো কুলকুণ্ডলিনী নিবাসিনী আদ্যাশক্তি স্বরুপিনী হুঙ্কার বীজোদ্ভবা কালী কৈবল্যদায়িনী । যা উর্ধমুলোস্থিত মহাশূন্যকে নির্দেশ করে ।


‘ক’— এই চিহ্নের সঙ্গে ‘ক’ বর্ণের সম্পর্ক তো আপতিক, এবং এই কারণে বর্ণ অবিনাশী। তাই বলা হয় এই জগৎ শব্দময় এবং ব্রহ্মই এই শব্দসমূহের উৎস। শব্দ শুধু প্রমাণ নয়, জ্ঞানের বিষয়, জ্ঞান, এমনকি জ্ঞাতাচৈতন্যও শব্দ।

জনক রাজাকে যাজ্ঞবল্ক্য ব্যাখ্যা করছেন, সমস্ত বেদ, ইতিহাস, পুরাণ, বিদ্যা, উপনিষৎ, শ্লোক, সূত্র, অনুব্যাখ্যান, ব্যাখ্যান, ইষ্ট, হোম, অশন, পানীয়, ইহলোক, পরলোক, সর্বভূত, এমনকি বন্ধুকেও বাক্‌ দ্বারাই জানা যায়। বাক্‌ই পরম ব্রহ্ম।


ব্রহ্মাণ্ডের যাবৎ বস্তু, পদার্থ বা যা কিছুই কোনো না কোনো শব্দের অর্থ। এই অর্থ কি হল তাহলে, যা শব্দ দ্বারা কোনো বস্তু (being or matter) কে প্রকাশ করা হল। এই প্রকাশ বা expression কে বলা হচ্ছে স্ফোট যা আর কিছুই নয়, বুদ্ধিতে বস্তুর উপলব্ধি বা প্রতীতি। এই প্রতীতি শব্দটির মধ্যেই বলা আছে এর বুদ্ধিতে বস্তুর প্রকাশ। বুদ্ধি, অর্থাৎ প্রতীতি বস্তুকে যে ভাবে প্রকাশ করে থাকে, তার অতিরিক্ত কোনও সত্তা বস্তুর নেই। থাকলেও জীব বিশেষে তা তার বুদ্ধির কাছে তখনও প্রকাশিত হয়নি।


যখন জীব শব্দ এবং তার অৰ্থ পৃথক করতে পারেনা তাই বৈখরী স্তরে থাকে। সাধক রাজা ভর্তৃহরি বলছেন ত্রিবিধ নাদ যথা বৈখরী, মধ্যমা ও পশ্যন্তি নিয়ে যে ‘অনেকতীর্থভেদায়া’। এখানে তীর্থ অর্থে অনেক মানে হলেও সাধনার ক্ষেত্রে আমরা ধরি বিভিন্ন চক্রকে। তীর্থ, অর্থাৎ অধিষ্ঠান। প্রাণ (শ্বাস), বুদ্ধি এবং হৃদয়কে আশ্রয় করে যথাক্রমে বৈখরী, মধ্যমা এবং পশ্যন্তী ‘আত্মলাভ’ করে।


আবার যদি ধাতু থেকে দেখি দেখব, ‘তীর্থ’ এসেছে ‘তর্‌’ ধাতু থেকে। ‘তর্‌’ গতিব্যঞ্জক, যা থেকে তরণ বা পার হওয়া বা বেগের পরিবর্তন ও বোঝায়। তীর্থ মানে ঘাটও। ভাষা-নদী তিনটি ঘাটকে স্পর্শ করে কেমন বয়ে চলেছে! বাক্‌ স্রোতস্বিনী, শব্দময় এই প্রপঞ্চ যে কাল-শক্তিরই ক্রিয়া, সে কথা সাধক রাজা বলছেন।

বললাম জল এখন জল শুধু ধ্বনি নয় এর শব্দ এবং শব্দার্থ আমাদের কাছে একভাবে প্রস্ফুটিত হয়। অর্থাৎ জল বললে শব্দ ও অর্থের যুগলবন্দী বোঝায়। তাই মহাকবি কালিদাস শিব-পার্বতীকে বোঝাতে বাক্‌ ও অর্থের মতোই সম্পৃক্ত বলেছেন।


জ্ঞান আর জ্ঞেয় এই উভয়ই এক ভাবে বাক দ্বারা প্রকাশ হল বা নাদ দ্বারা বুদ্ধিতে প্রকাশ হল। এখানে বিশুদ্ধ স্থিতিতে পৌঁছানো গেল না। সাধনার ক্রমে এই নাদের ও ক্রম আসে। বৈখরী থেকে থেকে মধ্যমা থেকে নাদের সূক্ষ্মতম অবস্থা পশ্যন্তী।


এই ক্রম নিয়ে পরে কখনো লিখব। চৈতন্য জ্ঞাতা, সেও তো বাগ্‌রূপতাকে অতিক্রম করতে পারে না পশ্যন্তি স্তর অবধি। পরা স্তরে গিয়ে জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা (অর্থাৎ চৈতন্য ) সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। তখন আসে সেই আনন্দ। সেই বিশুদ্ধ।


অজপা যখন বন্ধ হবে তখন সাধনায় আসে নাদ। তারপরই আসে সাধনার সেই গতি। নাদ তখন তীর্থ থেকে তীর্থে ঘুরে বিশুদ্ধতে পৌঁছায়।




Share this Page

Subscribe

Get weekly updates on the latest blogs via newsletters right in your mailbox.

Thanks for submitting!

bottom of page