অবধূত গুরু সন্নিধ্যানে ব্যাখ্যা করলেন লালন সাঁইয়ের এক পদকে। "ঘরে একটা মানুষ আছে তারে চেনো না।"
ঘরে একটা মানুষ আছে তারে চেনো না লালন সাঁই-এর এই বিখ্যাত পদ আশ্রমের এক সংকীর্তন উৎসবে দিবাকর দাস বাউল যখন গাইলেন মন তখন চলে গেলো লালন সাঁই-এর কথা গুলোতে যাতে তিনি আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব ও কুণ্ডলিনী চক্রকে অপূর্ব ভাবে বর্ণনা করেছেন।
ঘরে একটা মানুষ আছে তারে চেনো না।
লালন তাঁর গানের প্রথম লাইনেই বলে দিলেন অনেক কথা দুটি শব্দের মধ্যে দিয়ে। যার একটি 'ঘর' আর একটি মানুষ। আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে আমাদের ঘর ও একজন মানুষ। বাউল বা এই ধরণের গানে যে ভাব ও ভাষা প্রয়োগ করা হয় তা মূল ভাব কে গুপ্ত ও গুহ্য রাখে। এখানে ঘর হলো দেহ আর মানুষ হলো আত্মা। তন্ত্রে যেমন বলা হয় যা আছে ভান্ডে তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে। এখানেও কথাটা সে রকমই।
পরের লাইনে লালন সাঁই বলছেন, "তারে চিনে ভালোবাসলে পরে মরণের ভয় থাকবে না।"
তারে চিনে অর্থাৎ সেই আত্মাকে চিনে ভালোবাসলে আর মরণের ভয় থাকে না। তার কারণ মানুষের মৃত্যভয় সর্বাধিক ভয়। দেহের সাথে তার মন জড়িয়ে এক অজানা আশংকা তৈরী করে রাখে। আর সেই আত্মাকে ভালো বাসলে আর কোনো ভয় থাকবে না। এখানে প্রেম সেই পরমাত্মার সঙ্গে যা দেহে আত্মা স্বরূপ।
দিবাকর দাস বাউল, বোলপুর, শান্তিনিকেতন
২০৬টি টুকরো কাঠে বিনা পেরেকে এ ঘর আঁটে, কি অপূর্ব দেহত্বত্তের বর্ণনা।
মানব দেহে ২০৬টি হাড় থাকে। তাই লালন সাঁই বলছেন তাঁর লেখায় মালিক অর্থাৎ সেই পরমাত্মা কোনো পেরেক ছাড়াই ২০৬টি কাঠ জুড়ে দেহ নামক এই ঘর তৈরী করেছেন করেছেন।
এর পরের লাইনেই সবচেয়ে বড়ো চমক। "আবার ৩৬০টি তার লাগাইয়া মালিক চালায় কারখানা।" কি এই ৩৬০ টি তার? এই ৩৬০টি তার হলো ৩৬০টি এমন স্নায়ু যার দ্বারা মানবদেহ বেশিরভাগ কার্য চলে। আবার ভগবান বিশুদ্ধানন্দ পরমহংসদেব তার সূর্য্য বিজ্ঞান সাধনা নিয়ে বোঝাতে গিয়ে বলেছেন ৩৬০টি সূর্যের রশ্মির কথা।
আট কুঠুরি নয় দরজা, ঘরে ৩জন উজীর ৩জন রাজা। অসাধারণ পদ। ৮কুঠুরি গুপ্ত অনাহত কে ধরে ৮টি চক্র, আমাদের মানব শরীরে ৯টি দ্বার। এই হলো আট কুঠুরি নয় দরজা। ৩জন উজীর কারা তিন উজীর? ত্রিশক্তি। মহা কালী, মহা লক্ষ্মী, মহাসরস্বতী, আর তিনজন রাজা হলো ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং রুদ্র। "আবার ৩তলা ঘর ভারী মজা" - তন্ত্রের ভাষ্যতে বলছে ব্রহ্মা গ্রন্থি, বিষ্ণু গ্রন্থি আর রুদ্র গ্রন্থি এই সেই তিনতলা ঘর। লালন সাঁই একেই তিনতলা ঘর বলেছেন।
"৫জনা বারোসখানা" - আর ৫জনা বারোসখানা লালন সাঁই এর এই কথার মধ্যদিয়ে পৃথ্বী তত্ত্ব, জলতত্ত্ব, অগ্নিতত্ত্ব, বায়ুতত্ত্ব, এবং আকাশতত্ত্ব এই ৫টি মূল ত্বত্তকে বলেছেন। আবার এভাবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে মানব দেহের পঞ্চ কোষ।
৭তলা ঘর সিংহাসনে, আছেন মালিক নিজের গানে। এখানে লালন সাঁই বোঝালেন সহস্রারে মালিক অর্থাৎ সেই পরমাত্মা তাঁর নিজের গানে বিভোর থাকেন। সিরাজ লালন বলে একমনে কর গুরুর সাধনা। অসাধারণ এই পদ তান্ত্রিক সাধনার বা দেহত্বত্তের এক অপরূপ বর্ণনা